ভূমিকম্প আসলে কী? ভুমিকম্পের সময় কি করনীয়?
মোহাম্মদ বাইতুল্লাহ। ঢাকাপোস্ট ডট নেট।
ভূমিকম্প আসলে কী?
ভূমিকম্পকে সোজা কথায় বলতে গেলে, এটা হলো পৃথিবীর কাঁপুনি। একদম ঠিক যেমনটা আমরা ভয় পেলে বা ঠাণ্ডায় কাঁপতে থাকি, পৃথিবীও মাঝে মাঝে এমন করে কেঁপে ওঠে।
আমাদের এই বিশাল পৃথিবীর ওপরের স্তরটা অনেকগুলো বড় বড় পাথরের টুকরো বা প্লেট দিয়ে তৈরি। অনেকটা বিশাল আকারের পাজলের টুকরোর মতো আর কি। এই প্লেটগুলো কিন্তু এক জায়গায় স্থির থাকে না, এগুলো সব সময় খুব ধীরে ধীরে নড়াচড়া করছে। আমাদের চোখে পড়ছে না, কারণ এই গতিটা এতটাই ধীর যে আমরা বুঝতেই পারি না।
কিন্তু সমস্যাটা হয় যখন এই প্লেটগুলো একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায়, ঘষা খায় বা একটার নিচে আরেকটা ঢুকে যায়। এই ধাক্কা বা ঘষা লাগার ফলে প্লেটগুলোর ভেতরে অনেক শক্তি জমা হয়। এই শক্তি যখন আর ভেতরে ধরে রাখা যায় না, তখন হঠাৎ করে ভীষণ জোরে বাইরে বেরিয়ে আসে। আর এই শক্তি বেরিয়ে আসার ফলেই পুরো পৃথিবীটা কেঁপে ওঠে। এটাই হলো ভূমিকম্প।
ভূমিকম্পটা ছোটও হতে পারে, তখন আমরা হয়তো তেমন একটা বুঝতেই পারি না, আবার অনেক বড়ও হতে পারে, যা কিনা অনেক বড় বড় দালান-কোঠা ভেঙে দিতে পারে, রাস্তাঘাট ফাটিয়ে দিতে পারে। আর এর ফলে সুনামিও হতে পারে, যদি ভূমিকম্পটা সমুদ্রের নিচে হয়।
ভূমিকম্প কেনো হয়?
আমরা তো একটু আগেই কথা বললাম যে ভূমিকম্প মানে হলো পৃথিবীর কেঁপে ওঠা, তাই না? এখন এই কাঁপুনিটা কেন হয়, সেটা জানতে গেলে একটু গভীরের কথা বলতে হবে। ভাবুন তো, আমাদের এই বিশাল পৃথিবীর ওপরে যে কঠিন ভূত্বকটা আছে, সেটা কিন্তু একটা আস্ত ফুটবল বা আপেলের খোসার মতো মসৃণ নয়।
এটাকে আপনি বরং অনেকগুলো বড় বড় ফাটল বা ভাঙা টুকরা দিয়ে তৈরি একটা পাজলের মতো ভাবতে পারেন। ভূবিজ্ঞানীরা এদের নাম দিয়েছেন টেকটোনিক প্লেট। এই প্লেটগুলো কিন্তু বসে নেই, সব সময় খুব, খুব ধীরে ধীরে নড়াচড়া করছে। এতটাই ধীরে যে আমরা বুঝতেই পারি না, বছরে হয়তো কয়েক সেন্টিমিটার। অনেকটা নখের বাড়ার গতির মতো আর কি!
এখন সমস্যাটা হয় যখন এই প্লেটগুলো নড়াচড়া করতে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায়, ঘষা খায়, বা একটার নিচে আরেকটা ঢুকে যায়। এই যে নড়াচড়া বা ঘষাঘষি, এর ফলে প্লেটগুলোর কিনারাগুলোতে ** énormously চাপ বা শক্তি জমা হতে থাকে**। এটা অনেকটা একটা স্প্রিংকে চেপে রাখার মতো বা একটা রাবার ব্যান্ডকে টানার মতো। আপনি স্প্রিং বা রাবার ব্যান্ডকে টানতে টানতে একটা নির্দিষ্ট সীমার পর যখন আর চাপ ধরে রাখতে পারেন না, তখন কী হয়? হঠাৎ করে সেগুলো সটান হয়ে যায় বা ছিঁড়ে যায়, তাই না?
পৃথিবীর প্লেটগুলোর ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই ঘটে। যখন এই জমা হওয়া চাপ এতটাই বেড়ে যায় যে পাথরগুলো আর সেই চাপ সহ্য করতে পারে না, তখন হঠাৎ করে বিশাল একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সেই শক্তিটা বেরিয়ে আসে। আর এই শক্তি বেরিয়ে আসার ফলেই পুরো পৃথিবীটা কেঁপে ওঠে। এই জায়গাগুলো, যেখানে প্লেটগুলো ধাক্কা খায় বা ফাটল ধরে, সেগুলোকে আমরা ফল্ট লাইন বলি। বেশিরভাগ ভূমিকম্প এই ফল্ট লাইনগুলোতেই হয়।
আসলে ব্যাপারটা হলো, আমাদের পায়ের নিচের মাটিটা কিন্তু সব সময় অস্থির থাকে, নড়াচড়া করে। আর সেই নড়াচড়ার ফলে যখন চাপ বাড়ে আর হঠাৎ করে সেই চাপ মুক্ত হয়, তখনই ঘটে যায় ভূমিকম্প!

ভূমিকম্পের সময় কি করবেন?
১. প্রথম কাজ: সোজা “ড্রপ, কাভার, হোল্ড অন” পদ্ধতি!
এটা হলো ভূমিকম্পের সময় আপনার বাঁচার জন্য সবচেয়ে সহজ আর কার্যকর উপায়।
- ড্রপ (Drop): মানে হলো, সঙ্গে সঙ্গে যেখানে আছেন, সেখানেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ুন বা হামাগুড়ি দেওয়ার মতো নিচু হয়ে যান। একদম দৌঁড়াদৌঁড়ি করবেন না।
- কাভার (Cover): যত দ্রুত সম্ভব, কোনো মজবুত টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত কিছুর নিচে চলে যান। হাত দিয়ে নিজের মাথা আর ঘাড় ঢেকে ফেলুন। যদি আশেপাশে কিছু না পান, তাহলে কোনো ভেতরের দেয়ালের পাশে গিয়ে বসে পড়ুন এবং হাত দিয়ে মাথা ও ঘাড় রক্ষা করুন। মনে রাখবেন, লিফট বা জানালার কাছাকাছি একদম নয়!
- হোল্ড অন (Hold On): যেই টেবিল বা ডেস্কের নিচে গিয়েছেন, সেটাকে শক্ত করে ধরে থাকুন। যতক্ষণ না কাঁপুনি থামছে, ততক্ষণ ওখান থেকে নড়বেন না। যদি টেবিল বা চেয়ার সরে যায়, তাহলে সেটার সঙ্গে সঙ্গেই সরুন, যাতে সেটার নিচে থাকতে পারেন।
২. যদি বাড়ির ভেতরে থাকেন:
- লিফট ব্যবহার করবেন না। সিঁড়ি ব্যবহার করুন, তবে কাঁপুনির সময় সিঁড়িও বিপজ্জনক হতে পারে।
- বড় কাঁচের জানালা, আয়না, লম্বা আলমারি বা যেকোনো কিছু যা পড়ে যেতে পারে, সেগুলোর থেকে দূরে থাকুন।
- রান্নাঘরের ভেতরে থাকলে গ্যাসের চুলা বন্ধ করে দিন (যদি নিরাপদে করতে পারেন)।
৩. যদি বাড়ির বাইরে থাকেন:
- যথা সম্ভব খোলা জায়গায় চলে যান।
- বড় বিল্ডিং, গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, তার বা যেকোনো ঝুলন্ত জিনিস থেকে দূরে থাকুন। এগুলো আপনার ওপর ভেঙে পড়তে পারে।
- মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ুন এবং মাথা ঢেকে নিন।
৪. যদি গাড়িতে থাকেন:
- ধীরে ধীরে গাড়িটাকে রাস্তার পাশে কোনো খোলা জায়গায় নিয়ে থামান।
- ব্রিজ, ফ্লাইওভার, সুড়ঙ্গ বা বিদ্যুতের তারের নিচে গাড়ি থামাবেন না।
- গাড়ির ভেতরেই থাকুন এবং কাঁপুনির শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
৫. ভূমিকম্প থেমে যাওয়ার পর:
- সাবধান! আসল কাঁপুনির পর আফটারশক বা ছোট ছোট কাঁপুনি আসতে পারে। তাই সাবধানে থাকুন।
- নিজেকে এবং আপনার আশেপাশের লোকদের দেখুন, কেউ আহত হয়েছে কিনা।
- গ্যাস লিক বা বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে কিনা, সেটা খেয়াল করুন। গ্যাসের গন্ধ পেলে জানালা খুলে দিন এবং দ্রুত বাড়ি থেকে বের হয়ে যান, তবে ম্যাচের কাঠি জ্বালাবেন না বা ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট ব্যবহার করবেন না।
- জরুরী বার্তা শুনুন এবং কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে চলুন।
- আশেপাশের বিল্ডিংয়ের ক্ষতি হয়েছে কিনা দেখুন, যদি বিপজ্জনক মনে হয়, তাহলে ওগুলো থেকে দূরে থাকুন।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, মাথা ঠাণ্ডা রাখা। কারণ, ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে পারলে অনেক বিপদ এড়ানো যায়। আশা করি, এই কথাগুলো আপনাকে সাহায্য করবে!
ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পাওয়া যায় কিভাবে?
ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পাওয়া গেলে তো কত বড় বিপদ থেকে বাঁচা যেত, তাই না? এটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা দিনরাত কাজ করছেন, মাথা ঘামাচ্ছেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, এখনো পর্যন্ত ভূমিকম্পের একদম সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি!
এটাকে আপনি অনেকটা এভাবে ভাবতে পারেন: ধরুন, আপনি একটা কাঠির ওপর ক্রমাগত চাপ দিচ্ছেন। আপনি জানেন যে চাপ দিতে থাকলে একসময় কাঠিটা ভাঙবে, কিন্তু ঠিক কখন ভাঙবে, বা ঠিক কোন জায়গা থেকে ভাঙবে, সেটা কি একদম নির্ভুলভাবে বলা সম্ভব? খুব কঠিন, তাই না? ভূমিকম্পের ব্যাপারটা আরও জটিল।
আমাদের পৃথিবীর নিচে যে টেকটোনিক প্লেটগুলো আছে, সেগুলোর নড়াচড়াটা এতটাই অনিয়মিত আর এত বিশাল শক্তির ব্যাপার যে, বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করেও এর ঠিক কখন আর কত বড় একটা ঝাঁকুনি হবে, তা বলতে পারেন না।
তাহলে বিজ্ঞানীরা কী করতে পারেন?
১. লম্বা মেয়াদের পূর্বাভাস (Long-term Forecasting): বিজ্ঞানীরা জানেন পৃথিবীর কোন কোন এলাকাগুলো ফল্ট লাইনের ওপর অবস্থিত, যেখানে প্লেটগুলো ধাক্কা খায়। যেমন, জাপান, ক্যালিফোর্নিয়া, বা আমাদের হিমালয় অঞ্চলের কাছাকাছি এলাকাগুলো। এই জায়গাগুলোতে ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি, কিন্তু সেটা আগামী ১০ বছর, ৫০ বছর বা ১০০ বছরের মধ্যে কবে হবে, তা বলা কঠিন। এটা অনেকটা আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো, যেখানে বলা হয় ‘আজ বৃষ্টি হতে পারে’, কিন্তু ঠিক কখন আর কোথায়, তা বলা যায় না।
২. ক্ষুদ্র পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ (Studying Precursors): বিজ্ঞানীরা কিছু ছোট ছোট পরিবর্তনের দিকে নজর রাখেন, যেগুলো হয়তো বড় ভূমিকম্পের আগে দেখা যেতে পারে। যেমন:
* ছোট ছোট কম্পন (Foreshocks): মাঝে মাঝে বড় ভূমিকম্পের আগে ছোট ছোট কম্পন হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, সব ছোট কম্পনই যে বড় ভূমিকম্পের লক্ষণ, তা নয়। অনেক সময় ছোট কম্পন হয়েই থেমে যায়।
* ভূগর্ভস্থ জলের স্তরের পরিবর্তন: মাটির নিচের জলের স্তর অস্বাভাবিকভাবে কমে বা বেড়ে যেতে পারে।
* গ্যাসের নির্গমন: মাটি থেকে কিছু নির্দিষ্ট গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।
* ভূচৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন: পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রে কিছু অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা যেতে পারে।
* প্রাণীর আচরণ: অনেক সময় শোনা যায়, ভূমিকম্পের আগে কুকুর, বিড়াল বা পাখিদের আচরণ অস্বাভাবিক হয়ে যায়। এটা নিয়ে গবেষণা চলছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত এর কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে এটা দিয়ে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া যায়।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এই কোনো লক্ষণই ১০০% নির্ভরযোগ্য নয়। একটা লক্ষণ দেখা দিলেই যে ভূমিকম্প হবে, এমনটা বলা যায় না। আর যখন ভূমিকম্প হয়, তখন সেটা এতটাই হঠাৎ করে হয় যে, হয়তো কয়েক সেকেন্ড বা কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব শেষ!
এজন্যই, পূর্বাভাস পাওয়ার আশায় বসে না থেকে, আমাদের নিজেদের প্রস্তুত থাকাটাই সবচেয়ে জরুরি। যেমনটা আমরা একটু আগে আলোচনা করলাম, ভূমিকম্পের সময় কী করা উচিত, সেই নিয়মগুলো জানা আর সেই অনুযায়ী কাজ করার প্রস্তুতি নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি কতটুকু?
সোজা কথায় বলতে গেলে, আমাদের বাংলাদেশ একটা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। মানে, এখানে ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা ভালোই আছে, এবং বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ারও ঝুঁকি থাকে।
কেন জানেন?
আমাদের এই সুন্দর দেশটা এমন একটা জায়গায় বসে আছে, যেখানে পৃথিবীর নিচের কয়েকটা বিশাল টেকটোনিক প্লেট একে অপরের সঙ্গে লাগোয়া। ভাবুন তো, আমাদের পায়ের নিচে থাকা মাটিটা আসলে কয়েকটা বিশাল বিশাল পাথরের টুকরো দিয়ে তৈরি, আর এই টুকরোগুলো সব সময় খুব ধীরে ধীরে নড়াচড়া করছে। বাংলাদেশটা মূলত ইন্ডিয়ান প্লেট, ইউরেশিয়ান প্লেট আর বার্মিজ প্লেটের মাঝখানে স্যান্ডউইচের মতো আছে।
- ইন্ডিয়ান প্লেট: এই প্লেটটা উত্তর দিকে, মানে হিমালয়ের দিকে, অনবরত ঠেলে যাচ্ছে।
- ইউরেশিয়ান প্লেট: এটা হিমালয়ের ওপরে আছে, ইন্ডিয়ান প্লেটকে বাধা দিচ্ছে।
- বার্মিজ প্লেট (বা সুন্দা প্লেট): এটা বাংলাদেশের পূর্ব দিকে আছে, এবং এর সঙ্গে আমাদের দেশ লেগে আছে।
এই প্লেটগুলো যখন একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায়, ঘষা খায় বা একটার নিচে আরেকটা ঢুকে যায়, তখনই কিন্তু ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। আর যেহেতু বাংলাদেশ এই সক্রিয় প্লেটগুলোর একদম সংযোগস্থলের কাছাকাছি, তাই এখানে চাপ বা শক্তি জমা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
আমাদের দেশের আশেপাশে কিছু বড় বড় ভূমিকম্পের ফল্ট লাইন আছে, যেগুলো সক্রিয়। যেমন, আমাদের উত্তরে আছে ডাউকি ফল্ট, আর পূর্বে আছে বেশ কিছু বড় ফল্ট লাইন, যেগুলো বার্মিজ প্লেটের সঙ্গে জড়িত। এছাড়াও, দেশের ভেতরেও কিছু সুপ্ত বা ছোট ফল্ট লাইন থাকতে পারে। এই ফাটলগুলোতে যখন শত শত বছরের চাপ জমা হয়ে হঠাৎ করে বেরিয়ে আসে, তখন বড় ধরনের ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এই অঞ্চলে অতীতে অনেক বড় বড় ভূমিকম্প হয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় যে এখানকার মাটি আসলেই বেশ সক্রিয়।
আর একটা ব্যাপার কী জানেন? আমাদের দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি, আর অনেক ভবনই ভূমিকম্প সহনশীল করে তৈরি নয়। তাই যদি একটা বড় মাপের ভূমিকম্প হয়, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
তার মানে এই নয় যে আমরা সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকব। এর মানে হলো, আমাদের সচেতন থাকতে হবে এবং ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যেহেতু ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া যায় না, তাই প্রস্তুতিই হলো আসল হাতিয়ার।
এই হলো মোটামুটি বাংলাদেশের ভূমিকম্পের ঝুঁকির একটা ধারণা।

ভূমিকম্পের মাত্রা কেমন হয়?
যখন ভূমিকম্প হয়, তখন মাটির নিচে থেকে আসলে কতটা শক্তি বেরিয়ে এলো, সেটা মাপা হয় একটা স্কেল দিয়ে। এর নাম রিখটার স্কেল (বা আজকাল আরও নির্ভুলভাবে মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেল ব্যবহার করা হয়)।
এটাকে আপনি একটা মজার উপমা দিয়ে ভাবতে পারেন: ধরুন, এটা একটা পরীক্ষার নম্বরের মতো। কিন্তু সাধারণ পরীক্ষার নম্বরের মতো নয় যে, ৫ এর চেয়ে ৬ এক নম্বর বেশি। ভূমিকম্পের মাত্রাটা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, স্কেলে প্রতি এক ধাপ বাড়লে ভূমিকম্পের ক্ষমতা বা শক্তি ১০ গুণ বেশি হয়ে যায়! আর এই শক্তি যখন বেরিয়ে আসে, তখন সেটা প্রায় ৩২ গুণ বেশি শক্তিশালী হয় আগের মাত্রার চেয়ে। মানে, ৬ মাত্রার ভূমিকম্প ৫ মাত্রার ভূমিকম্পের চেয়ে ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী এবং ৩২ গুণ বেশি শক্তি নির্গত করে! ভাবা যায়?
তো, এই মাত্রাগুলো কেমন হলে আমরা কী বুঝব, চলুন একটু দেখে নিই:
- ২.০ থেকে ২.৯ মাত্রা:
- কেমন হয়: এটা হলো একদম হালকা কাঁপুনির মতো। আমরা হয়তো বুঝতেই পারি না, বা খুব দুর্বলভাবে অনুভব করি। ছোট ছোট জিনিসপত্র হয়তো একটু নড়তে পারে।
- উদাহরণ: ফ্রিজের ভেতর রাখা বোতলের পানি হয়তো একটু নড়লো, কিন্তু আপনি টের পেলেন না।
- ৩.০ থেকে ৩.৯ মাত্রা:
- কেমন হয়: এটা একটু বেশি বোঝা যায়। মনে হতে পারে, একটা বড় ট্রাক পাশের রাস্তা দিয়ে গেল, বা হালকা কিছু নড়ে উঠলো।
- উদাহরণ: ফ্যানের ব্লেড হয়তো একটু কাঁপলো, বা দেয়ালের ছবির ফ্রেম একটু বাঁকা হয়ে গেল।
- ৪.০ থেকে ৪.৯ মাত্রা:
- কেমন হয়: এই মাত্রায় কম্পনটা বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়। বিছানা বা চেয়ারে বসে থাকলে হয়তো সেটা নড়ে উঠবে। ভেতরে থাকা জিনিসপত্র নড়তে শুরু করবে।
- উদাহরণ: ঘরে থাকা কাঁচের গ্লাসগুলো ঠোকাঠুকি করতে পারে, আলমারির দরজার আওয়াজ হতে পারে। কিছু পুরনো বা দুর্বল কাঠামোতে সামান্য ক্ষতি হতে পারে।
- ৫.০ থেকে ৫.৯ মাত্রা:
- কেমন হয়: এটা বেশ শক্তিশালী ভূমিকম্প! ঘরের ভেতরে থাকা জিনিসপত্র পড়ে যেতে পারে, আসবাবপত্র সরে যেতে পারে। দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়তে পারে। দুর্বল বা পুরনো বিল্ডিংগুলোর বেশ ক্ষতি হতে পারে।
- উদাহরণ: টিভি বা ল্যাপটপ পড়ে যেতে পারে, ছাদের ঝাড়বাতি জোরে দুলতে পারে।
- ৬.০ থেকে ৬.৯ মাত্রা:
- কেমন হয়: এটা মারাত্মক শক্তিশালী! জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে। সাধারণ বিল্ডিংগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অনেক পুরনো বা দুর্বল বিল্ডিং ভেঙেও যেতে পারে। রাস্তাঘাটে ফাটল ধরতে পারে।
- উদাহরণ: বড় বড় ফাটল ধরে, বাড়িঘর ভেঙে পড়ে, অনেক মানুষকে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হয়।
- ৭.০ থেকে ৭.৯ মাত্রা:
- কেমন হয়: একে বলা হয় “মেজর” ভূমিকম্প। এটা প্রলয়ঙ্করী হতে পারে। বিশাল এলাকা জুড়ে ব্যাপক ধ্বংসলীলা ঘটাতে পারে। রাস্তা, ব্রিজ, রেললাইন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- উদাহরণ: শহরের অনেক অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে, অনেক মানুষের জীবনহানি হতে পারে।
- ৮.০ বা তার বেশি মাত্রা:
- কেমন হয়: এটা “গ্রেট” বা মহাপ্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প। এমনটা খুব কম দেখা যায়। কিন্তু যদি হয়, তাহলে এর ধ্বংসলীলা কল্পনাতীত। শত শত কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সবকিছু ধ্বংস করে দিতে পারে।
- উদাহরণ: ইতিহাসে এমন ভূমিকম্প খুব কম হয়েছে, কিন্তু যখন হয়েছে, তখন সেটা প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে রেখেছে তার ভয়াবহতার জন্য।
আশা করি, এখন বুঝতে পারছেন যে মাত্রাগুলো কীভাবে কাজ করে আর কেন একটা ছোট সংখ্যা বাড়লেই সেটা কতটা ভয়াবহ হতে পারে।
ভূমিকম্প থেকে বাঁচার উপায় কী?
দেখুন, ভূমিকম্প তো আর বলে-কয়ে আসে না। এটা হঠাৎ করেই আসে। তাই বাঁচার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো প্রস্তুত থাকা। এটাকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করে দেখতে পারি:
১. ভূমিকম্প হওয়ার আগে কী কী প্রস্তুতি নেবেন (প্রস্তুত থাকুন!):
- “ড্রপ, কাভার, হোল্ড অন” অভ্যাস করুন: এটা একটা খেলা বা অনুশীলনের মতো। যখনই ভূমিকম্পের কথা মনে আসবে, এটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য করে নিন। পরিবারের সবাইকে শেখান, অফিসের সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করুন। এতে আসল সময়ে আর ঘাবড়াবেন না।
- জরুরি কিট তৈরি রাখুন: একটা ব্যাগে কিছু জরুরি জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখুন। যেমন:
- বোতলজাত পানি (অন্তত তিন দিনের জন্য)
- কিছু শুকনো খাবার (বিস্কিট, চিঁড়ে, মুড়ি)
- ফার্স্ট এইড বক্স (ছোটখাটো আঘাতের জন্য)
- টর্চলাইট আর অতিরিক্ত ব্যাটারি
- একটা হুইসেল বা বাঁশি (যদি আটকা পড়েন, তাহলে বাঁশি বাজিয়ে সাহায্য চাইতে পারবেন)
- পাওয়ার ব্যাংক আর চার্জার
- কিছু দরকারি কাগজপত্র (পরিচয়পত্র, গুরুত্বপূর্ণ ফোন নম্বর)
- নিরাপদ জায়গা চিহ্নিত করুন:
- ঘরের ভেতরে: আপনার বাড়ির কোথায় মজবুত টেবিল, ডেস্ক বা চৌকির মতো জায়গা আছে, যেখানে আপনি আশ্রয় নিতে পারবেন, সেগুলো আগে থেকে ঠিক করে রাখুন। জানালার কাছ থেকে বা কাঁচের জিনিসপত্র থেকে দূরে থাকবেন।
- ঘরের বাইরে: আপনার বাড়ির আশেপাশে বা অফিসের বাইরে কোথায় খোলা জায়গা আছে, যেখানে বিল্ডিং, গাছ বা বিদ্যুতের তার নেই, সেটা জেনে রাখুন।
- ভারী জিনিসপত্র সুরক্ষিত করুন: আলমারি, বুকশেলফ বা যেকোনো ভারী আসবাবপত্র দেয়ালের সঙ্গে ভালো করে আটকে রাখুন, যাতে কম্পনের সময় সেগুলো আপনার ওপর না পড়ে যায়।
- ইউটিলিটির সুইচ চিনুন: আপনার গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানির মূল সুইচগুলো কোথায় আছে, সেগুলো চিনে রাখুন। প্রয়োজনে যেন দ্রুত বন্ধ করতে পারেন।
- পরিবারের সাথে পরিকল্পনা: পরিবারের সবাই মিলে ঠিক করুন, ভূমিকম্প হলে কে কী করবে, কোথায় যাবে, কার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। একটা নির্দিষ্ট মিলনস্থল ঠিক করে রাখুন।
২. ভূমিকম্প চলাকালীন কী করবেন (শান্ত থাকুন!):
- আবারও বলছি: “ড্রপ, কাভার, হোল্ড অন”! এটা হলো আপনার জীবন বাঁচানোর মূলমন্ত্র। মাটিতে বসে পড়ুন, কোনো মজবুত কিছুর নিচে আশ্রয় নিন এবং সেটাকে শক্ত করে ধরে থাকুন যতক্ষণ না কম্পন থামে।
- মাথা ঠাণ্ডা রাখুন: ঘাবড়ে যাবেন না। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিন এবং সেই অনুযায়ী কাজ করুন।
- দৌঁড়াদৌঁড়ি করবেন না: ভূমিকম্প চলাকালীন দৌঁড়াদৌঁড়ি করলে পড়ে গিয়ে বা অন্য কোনো কিছুর আঘাতে গুরুতর আহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- জানালার কাছ থেকে দূরে থাকুন: কাঁচ ভেঙে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
- লিফট ব্যবহার করবেন না: বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে, ফলে লিফটে আটকে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সিঁড়ি ব্যবহার করুন, তবে কম্পন থামার পর।
- বাইরে থাকলে খোলা জায়গায় যান: বিল্ডিং, বিদ্যুতের খুঁটি, গাছ বা যেকোনো ঝুলন্ত জিনিস থেকে দূরে সরে যান। মাটিতে বসে পড়ুন।
- গাড়িতে থাকলে: নিরাপদ জায়গায় গাড়ি থামিয়ে গাড়ির ভেতরেই থাকুন। ব্রিজ, ফ্লাইওভার বা সুড়ঙ্গের নিচে থামবেন না।
৩. ভূমিকম্প থেমে যাওয়ার পর কী করবেন (সচেতন থাকুন!):
- আফটারশকের জন্য প্রস্তুত থাকুন: বড় ভূমিকম্পের পর ছোট ছোট আফটারশক আসাটা খুব স্বাভাবিক। তাই সতর্ক থাকুন।
- নিজেকে ও অন্যদের পরীক্ষা করুন: কোনো আঘাত পেয়েছেন কিনা দেখুন। আশেপাশে কেউ আহত হলে দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দিন।
- বিপদ পরীক্ষা করুন:
- গ্যাসের গন্ধ পাচ্ছেন? সঙ্গে সঙ্গে জানালা খুলে দিন এবং ঘর থেকে বের হয়ে যান। দেশলাই জ্বালাবেন না বা কোনো ইলেকট্রনিক সুইচ অন-অফ করবেন না, কারণ এতে আগুন লাগতে পারে।
- বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে বা স্পার্ক করছে কিনা দেখুন।
- বিল্ডিংয়ের কাঠামোতে বড় ধরনের ফাটল বা ক্ষতি হয়েছে কিনা, তা পরীক্ষা করুন।
- নিরাপদ না হলে বেরিয়ে আসুন: যদি আপনার বাড়ি বা অফিস নিরাপদ মনে না হয় (যেমন, বড় ফাটল, গ্যাস লিক), তাহলে সতর্কতার সাথে বেরিয়ে এসে খোলা জায়গায় যান।
- জরুরী তথ্য শুনুন: রেডিও বা ব্যাটারিচালিত কোনো ডিভাইস দিয়ে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা শুনুন। গুজবে কান দেবেন না।
- সাহায্য করুন: আশেপাশে যারা বিপদে আছে, তাদের পাশে দাঁড়ান।
ভূমিকম্প থেকে বাঁচার উপায় আসলে আমাদের হাতেই। একটু প্রস্তুতি আর সচেতনতা আমাদের অনেক বড় বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে।
বাড়ি ভূমিকম্প-প্রতিরোধী করতে কী করণীয়?
দেখুন, ভূমিকম্পের সময় পৃথিবী যখন কেঁপে ওঠে, তখন আমাদের বাড়িগুলোও কিন্তু সেই ঝাঁকুনির সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে নড়তে চায়। যদি বাড়িটা খুব শক্তপোক্ত আর নড়াচড়া করার মতো নমনীয় না হয়, তাহলে ধপাস করে ভেঙে পড়ার ভয় থাকে। ব্যাপারটা অনেকটা বাঁশের মতো আর কি – বাঁশ যেমন ঝড়-তুফানে হেলেদুলে থাকে, ভেঙে পড়ে না। কিন্তু একটা শুকনো লাঠি হলে ঠাস করে ভেঙে যাবে। ভূমিকম্প-প্রতিরোধী বাড়িও অনেকটা এই বাঁশের মতোই, নমনীয় এবং মজবুত।
তো, একটা বাড়িকে ভূমিকম্প-প্রতিরোধী করতে গেলে কয়েকটা বিষয় খুব জরুরি:
১. নকশা আর ইঞ্জিনিয়ারিং – মূল ভিত্তি!
- সঠিক নকশা: প্রথমেই দরকার একজন অভিজ্ঞ আর্কিটেক্ট আর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের সাহায্য। তারা মাটির ধরন, এলাকার ভূমিকম্পের ঝুঁকি – সবকিছু বিচার করে বাড়ির একটা মজবুত নকশা তৈরি করবেন। এটা কিন্তু আপনার স্বপ্নের বাড়ির কঙ্কাল!
- মজবুত ভিত্তি (Foundation): বাড়ির ভিত্তিটা হতে হবে একদম পোক্ত! ভিত যত শক্তিশালী হবে, ভূমিকম্পের সময় মাটি কাঁপলেও বাড়িটা সহজে বসবে না বা দেবে যাবে না। অনেক সময় রিবন ফাউন্ডেশন বা ম্যাট ফাউন্ডেশন ব্যবহার করা হয়, যা ভূমিকম্পের শক্তিকে সমানভাবে ছড়াতে সাহায্য করে।
- ভালো মানের রড ও সিমেন্ট: এটা কিন্তু কোনো আপস করার জায়গা নয়! বিল্ডিংয়ের কঙ্কাল হলো রড আর সিমেন্টের গাঁথুনি। রডের গুণগত মান আর সিমেন্টের সঠিক মিশ্রণ ছাড়া একটা মজবুত কাঠামো তৈরি করা সম্ভব নয়। রডগুলো যেন ঠিকমতো বাঁধা হয়, তা নিশ্চিত করা জরুরি।
- কলাম আর বিম (Pillars and Beams): বাড়ির কলাম (খুঁটি) আর বিমগুলো (আড়াআড়ি কাঠামো) হলো বাড়ির আসল মেরুদণ্ড। এগুলোকে এমনভাবে ডিজাইন করতে হয় যাতে পুরো বাড়ির লোড সমানভাবে ছড়াতে পারে এবং কম্পনের সময় বাড়িটা এক ইউনিট হিসেবে কাজ করে।
- সঠিক বাঁধুনি বা জয়েন্ট (Connections): কলাম, বিম, দেয়াল আর ছাদ – এই সবগুলোর মধ্যে যেন একদম সঠিক আর মজবুত বাঁধুনি থাকে। যদি জয়েন্টগুলো দুর্বল হয়, তাহলে ভূমিকম্পের সময় এক অংশ আরেক অংশ থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারে, আর সেটাই বিপজ্জনক। চিন্তা করুন, শরীরের হাড়গুলো যদি জোড়া না থাকত, তাহলে কী হতো!
- দেয়ালের ধরন ও বন্টন: ইটের দেয়াল বা কংক্রিটের দেয়াল যাই হোক না কেন, দেয়ালগুলো যেন মজবুত হয় এবং ঠিকভাবে বন্টন করা থাকে। কিছু দেয়াল খুব লম্বা বা দুর্বল হলে সেগুলো সহজে ফেটে যেতে পারে বা ভেঙে যেতে পারে।
২. পুরনো বাড়ির জন্য কী করবেন (যদি নতুন না করতে পারেন)?
যদি আপনার বাড়ি পুরনো হয় এবং নতুন করে বানানোর সুযোগ না থাকে, তাহলেও হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
- বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন: একজন অভিজ্ঞ স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে আপনার বাড়িটা একবার পরীক্ষা করান। তিনি দেখে বলতে পারবেন, কোথায় কোথায় দুর্বলতা আছে এবং কীভাবে সেগুলোকে শক্তিশালী করা যায়।
- রেট্রোফিটিং বা শক্তিশালীকরণ: পুরনো কাঠামোকে নতুন করে মজবুত করার কিছু পদ্ধতি আছে। যেমন:
- ভিত্তি শক্তিশালী করা।
- কলাম বা বিমের চারপাশে অতিরিক্ত রড বা কংক্রিট দিয়ে শক্তি বাড়ানো।
- দেয়াল বা পিলারে ফাটল থাকলে সেগুলো ঠিক করা।
- কিছু নতুন সাপোর্ট বা ব্রেসিং যোগ করা।
৩. বাড়ির ভেতরের সুরক্ষাও জরুরি (নন-স্ট্রাকচারাল):
- ভারী জিনিসপত্র সুরক্ষিত করুন: বড় আলমারি, বুকশেলফ, ওয়াটার হিটার, ফ্রিজ – এগুলো যেন দেয়ালের সঙ্গে ভালো করে বোল্ট দিয়ে আটকানো থাকে। ভূমিকম্পের সময় এগুলো গায়ের ওপর পড়লে মারাত্মক বিপদ হতে পারে।
- ভারী জিনিসপত্র নিচে রাখুন: ভারী জিনিসগুলো চেষ্টা করবেন সবসময় নিচের তাকে বা নিচে রাখার। উপরের তাকে হালকা জিনিস রাখুন।
- ঝুলন্ত জিনিস পরীক্ষা করুন: সিলিং ফ্যান, ঝাড়বাতি বা অন্য কোনো ঝুলন্ত জিনিস যেন ভালো করে লাগানো থাকে, সেগুলো চেক করে নিন।
- নির্গমন পথ পরিষ্কার রাখুন: দরজা, করিডোর বা সিঁড়ির সামনে যেন কোনো কিছু দিয়ে পথ আটকানো না থাকে, যাতে জরুরি অবস্থায় দ্রুত বের হতে পারেন।
শেষ কথা হলো: ভূমিকম্প-প্রতিরোধী বাড়ি তৈরি বা মেরামত করাটা কোনো ছোটখাটো কাজ নয়। এটা সম্পূর্ণই একজন বিশেষজ্ঞ আর্কিটেক্ট ও ইঞ্জিনিয়ারের কাজ। তাঁদের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে কিছু করতে যাবেন না। আর হ্যাঁ, গুণগত মান নিয়ে কখনোই আপস করবেন না। ভালো উপকরণ আর সঠিক নির্মাণ পদ্ধতিই আপনার আর আপনার পরিবারের জীবন বাঁচাবে।ভূমিকম্পের সময় লিফট ব্যবহার করা যাবে কি?
ভূমিকম্পের সময় লিফট ব্যবহার করা যাবে কি?
একদম সোজা আর স্পষ্ট কথায় উত্তরটা হলো: না! ভূমিকম্পের সময় ভুলেও লিফট ব্যবহার করা যাবে না।
কেন যাবে না, জানেন?
ভাবুন তো, একটা লিফট চলে বিদ্যুতে, আর ভূমিকম্প মানেই কিন্তু বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বা লোডশেডিংয়ের ভয় থাকে। যখন পৃথিবীটা কাঁপে, তখন লিফটের ভেতরে থাকা তারগুলো ছিঁড়ে যেতে পারে, লিফটের কন্ট্রোল প্যানেল কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে। তখন কী হবে? আপনি মাঝপথে, হয়তো দশ তলা আর এগারো তলার মাঝখানে লিফটের ভেতরে আটকে পড়বেন! এটা তো একটা ফাঁদের মতো হয়ে যাবে, তাই না?
আর একটা ব্যাপার হলো, ভূমিকম্পের সময় বিল্ডিংগুলো কিন্তু দুলে ওঠে। এই দুলুনির ফলে লিফটের শ্যাফ্ট (যে ফাঁকা জায়গার ভেতর দিয়ে লিফট ওঠানামা করে) ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমনকি, লিফট তার জায়গা থেকে সরে গিয়ে উল্টেও যেতে পারে! একবার যদি লিফটটা এমন উল্টে যায় বা তার ছিঁড়ে যায়, তাহলে সেটা সরাসরি নিচে পড়ে যেতে পারে, যা খুবই ভয়াবহ একটা ব্যাপার।
তাই, মনে রাখবেন: ভূমিকম্প শুরু হওয়া মাত্রই লিফট থেকে দূরে থাকুন। যদি বিল্ডিংয়ের ভেতরে থাকেন, তাহলে দ্রুত “ড্রপ, কাভার, হোল্ড অন” পদ্ধতি অনুসরণ করুন এবং কম্পন থেমে গেলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসুন, লিফট নয়। সিঁড়ি ব্যবহার করার সময়ও খেয়াল রাখবেন, তাড়াহুড়ো না করে সাবধানে নামবেন।

ভূমিকম্পের পর খাবার পানি কীভাবে বিশুদ্ধ করবেন?
মনে রাখবেন, ভূমিকম্পের পর টিউবওয়েল, কল বা অন্য যেকোনো সোর্স থেকে আসা পানি সরাসরি পান করা ঠিক না। কারণ পাইপ ফেটে নোংরা পানি মিশে যেতে পারে। তখন আমাদের কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি জানতে হবে:
১. ফুটিয়ে নিন (এটা সেরা উপায়!):
এটা হলো পানি বিশুদ্ধ করার সবচেয়ে সহজ আর সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
- কীভাবে করবেন: কোনো পাত্রে পানি নিয়ে চুলায় বসিয়ে দিন। পানিটা যখন টগবগ করে ফুটতে শুরু করবে, তখনো আরও কমপক্ষে ১ মিনিট ভালোভাবে ফোটাতে থাকুন। যদি বেশি উঁচু জায়গায় থাকেন, যেমন পাহাড়ি এলাকায়, তাহলে ৩ মিনিট ফোটানো ভালো।
- কেন কাজ করে: এই ফোটানোর কারণে পানির ভেতরে থাকা বেশিরভাগ ক্ষতিকর জীবাণু, ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়া মরে যায়।
- কিছু টিপস:
- পানি ফোটানোর পর ঠাণ্ডা হতে দিন।
- ফোটানো পানিটা ঢেকে রাখুন, যাতে আবার নোংরা না হয়।
- ফোটানোর পর পানির স্বাদ কিছুটা পানসে মনে হতে পারে। সেটা ঠিক করার জন্য, পানিটাকে একটা পরিষ্কার পাত্র থেকে আরেকটা পরিষ্কার পাত্রে কয়েকবার ঢালুন। এতে পানিতে অক্সিজেন মিশে স্বাদটা ভালো হবে।
২. ব্লিচ বা ক্লোরিন ব্যবহার (যদি ফোটানোর উপায় না থাকে):
যদি আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা না থাকে বা গ্যাস লিক হওয়ার ভয় থাকে, তাহলে এই পদ্ধতিটা কাজে লাগাতে পারেন। তবে অবশ্যই খুব সাবধানে!
- কীভাবে করবেন: সাধারণ, সুগন্ধহীন household ব্লিচ (যেটা কাপড় ধুতে ব্যবহার করা হয়, যার মোড়কে সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট ৫-৬% লেখা থাকে) ব্যবহার করতে হবে। সুগন্ধি বা জেল ব্লিচ ভুলেও ব্যবহার করবেন না!
- এক লিটার পানিতে ২ ফোঁটা ব্লিচ দিন।
- পাঁচ লিটার পানিতে ১০ ফোঁটা ব্লিচ দিন।
- কেন কাজ করে: ব্লিচে থাকা ক্লোরিন পানির জীবাণু ধ্বংস করে।
- কিছু টিপস:
- ব্লিচ দেওয়ার পর পানিটাকে ভালোভাবে নেড়ে মিশিয়ে নিন।
- তারপর, কমপক্ষে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন। এই সময়ে ব্লিচ কাজ করবে।
- ৩০ মিনিট পর দেখবেন পানিতে হালকা ক্লোরিনের গন্ধ আসছে। যদি গন্ধ না আসে, তাহলে আরও ২ ফোঁটা ব্লিচ দিয়ে আবার ১৫ মিনিট অপেক্ষা করুন। গন্ধটা হালকা আসা মানেই পানি বিশুদ্ধ হয়েছে।
৩. ওয়াটার পিউরিফিকেশন ট্যাবলেট (যদি হাতের কাছে থাকে):
কিছু ট্যাবলেট পাওয়া যায় যেগুলো দিয়ে পানি বিশুদ্ধ করা যায়। এগুলো সাধারণত ফার্স্ট এইড কিটে বা জরুরি অবস্থায় ব্যবহারের জন্য রাখা হয়।
- কীভাবে করবেন: ট্যাবলেটের প্যাকেটের গায়ে যে নির্দেশনা দেওয়া আছে, সেটা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলুন। একেক ট্যাবলেটের মাত্রা একেক রকম হতে পারে।
৪. ফিল্টারিং (মূল পদ্ধতির আগে):
এটা সরাসরি পানি বিশুদ্ধ করে না, তবে পানিকে পরিষ্কার করে, যাতে ফোটানো বা ক্লোরিন ব্যবহার করা সহজ হয়।
- কীভাবে করবেন: একটি পরিষ্কার কাপড়, বা কফি ফিল্টার দিয়ে পানি ছেঁকে নিন। এতে বড় বড় ময়লা বা কণা দূর হয়ে যাবে।
- কেন কাজ করে: এটা শুধু দৃশ্যমান ময়লা দূর করে, কিন্তু জীবাণু মারে না। তাই, ফিল্টার করার পর অবশ্যই পানি ফুটিয়ে বা ব্লিচ দিয়ে বিশুদ্ধ করতে হবে।
পানি কোথা থেকে সংগ্রহ করবেন?
- যদি বৃষ্টি হয়, পরিষ্কার পাত্রে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করুন।
- বাড়িতে যদি পুরনো বরফ জমা থাকে, সেটা গলিয়ে ব্যবহার করতে পারেন।
- কমোডের ফ্লাশ ট্যাঙ্কে থাকা পানি (কমোডের ভেতরের অংশে, যেখানে ফ্লাশ করার জন্য পানি জমা থাকে) ব্যবহার করতে পারেন। তবে কমোডের বাটির ভেতরের পানি নয়!
কিছু জরুরি সতর্কতা:
- কখনো মেঘলা বা ঘোলা পানি সরাসরি পান করবেন না, যতক্ষণ না সেটাকে বিশুদ্ধ করছেন।
- কোনো পানি থেকে যদি অস্বাভাবিক গন্ধ আসে বা রঙ অন্যরকম মনে হয়, সেটা পান করা থেকে বিরত থাকুন।
- ভূমিকম্পের পর কলের পানি নিরাপদ মনে হলেও, ফুটিয়ে বা ব্লিচ দিয়ে ব্যবহার করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
ভূমিকম্পের সময় গাড়িতে থাকলে কী করবেন?
ধরুন, আপনি নিশ্চিন্তে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন, আর হঠাৎ করে মাটি কেঁপে উঠল! গাড়িটাও দুলতে শুরু করল! এমন অবস্থায় একদম ঘাবড়াবেন না, মাথা ঠাণ্ডা রেখে এই কয়েকটা কাজ করুন:
১. ধীরে ধীরে গাড়ি থামান:
* প্রথমেই যেটা করবেন, সেটা হলো ধীরে ধীরে গাড়ি থামান। হঠাৎ করে জোরে ব্রেক করবেন না, কারণ এতে পেছনের গাড়ি এসে ধাক্কা দিতে পারে।
* চেষ্টা করুন রাস্তার একদম ডান পাশে বা বাম পাশে সরে যেতে, যাতে অন্য গাড়িগুলোর চলাচলে সমস্যা না হয়।
২. খোলা জায়গায় থাকুন:
* গাড়ি থামানোর জন্য এমন একটা জায়গা বেছে নিন, যেখানে আশেপাশে বড় কোনো বিল্ডিং, গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, বিলবোর্ড বা ল্যাম্পপোস্ট নেই।
* ব্রিজ, ফ্লাইওভার, সুড়ঙ্গ বা বড় বড় সাইনবোর্ডের নিচ থেকে দ্রুত সরে যান। কারণ ভূমিকম্পের সময় এগুলো ভেঙে পড়ার বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি থাকে। কোনো দেয়াল বা খাড়া পাহাড়ের পাশ থেকেও দূরে থাকুন, ওগুলো থেকেও পাথর বা ধ্বংসাবশেষ পড়তে পারে।
৩. গাড়ির ভেতরেই থাকুন:
* একবার গাড়ি থামিয়ে নিরাপদ জায়গায় চলে গেলে, গাড়ির ভেতরেই থাকুন। গাড়ি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করবেন না। আপনার গাড়িটা আসলে আপনার জন্য একটা ভালো আশ্রয় হিসেবে কাজ করবে, কারণ এটা নড়াচড়া করতে পারে আর বাইরের পড়ার মতো জিনিস থেকে আপনাকে রক্ষা করবে।
* স্টিয়ারিং হুইল শক্ত করে ধরে রাখুন এবং মাথা ও ঘাড় নিচু করে বা হাত দিয়ে ঢেকে নিন।
৪. কম্পন শেষ হওয়ার অপেক্ষা করুন:
* যতক্ষণ না কম্পন পুরোপুরি থেমে যাচ্ছে, ততক্ষণ গাড়ির ভেতরেই থাকুন।
* কম্পন থেমে গেলে, সাবধানে চারপাশে দেখে নিন, রাস্তা আর চারপাশের পরিস্থিতি নিরাপদ কিনা।
৫. সাবধানে গাড়ি চালান (যদি সম্ভব হয়):
* ভূমিকম্পের পর রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, ফাটল ধরতে পারে, বা বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ে থাকতে পারে। তাই, খুব সাবধানে ধীরে ধীরে গাড়ি চালান।
* যদি দেখেন রাস্তা খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা সামনে যেতে পারছেন না, তাহলে গাড়িটা সেখানেই রেখে হেঁটে নিরাপদ জায়গায় চলে যান।
* রেডিও বা মোবাইলের মাধ্যমে জরুরি খবর বা রাস্তার আপডেট জানার চেষ্টা করুন।
মূল কথা হলো, ভূমিকম্পের সময় যখন গাড়িতে থাকবেন, তখন গাড়িটাকে আপনার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করুন। বাইরে বের হয়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি না করে বরং ভেতরেই থাকাটা বেশি নিরাপদ।
ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প কোনটি?
ইতিহাসের পাতায় অনেক বড় বড় ভূমিকম্পের কথা লেখা আছে, কিন্তু কোনটা সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল, সেটা আসলে কতো মানুষ মারা গেছে বা কতোটা ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, তার ওপর নির্ভর করে বলা যায়।
সত্যি বলতে কি, ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প কোনটা, সেটা বলা বেশ কঠিন। কারণ ‘সবচেয়ে ভয়াবহ’ বলতে অনেকে সবচেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প বোঝেন, আবার অনেকে বোঝেন যেখানে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে বা সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই দুটো কিন্তু এক জিনিস নয়!
চলুন, দু’দিক থেকেই বলি:
১. সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হওয়া ভূমিকম্প (Deadliest Earthquake):
যদি প্রাণহানির কথা বলেন, তাহলে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প হিসেবে ধরা হয় ১৫৫৬ সালের চীনের শানশি (Shaanxi) প্রদেশের ভূমিকম্পকে।
- কবে হয়েছিল: ১৫৫৬ সালের ২৩শে জানুয়ারি।
- কোথায়: চীনের শানশি প্রদেশ এবং তার আশেপাশের এলাকা।
- মাত্রা: আনুমানিক ৮.০ থেকে ৮.৩ মাত্রা। (যদিও মাত্রার দিক থেকে এটা সবচেয়ে বড় ছিল না, কিন্তু এর প্রভাব ছিল মারাত্মক)।
- কেন এত ভয়াবহ: অনুমান করা হয়, এই ভূমিকম্পে প্রায় ৮ লাখ ৩০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন! ভাবা যায়! সেই সময় চীনের জনসংখ্যা কম থাকলেও, এই সংখ্যাটা ছিল অবিশ্বাস্যরকম বেশি। এর কারণ ছিল সেই এলাকার দুর্বল নির্মাণ কাঠামো, মাটির নিচে গুহা বা সুড়ঙ্গতে অনেক মানুষের বসবাস এবং ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ভূমিধস ও ফাটল। পুরো একটা শহর একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল!
২. সবচেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প (Largest Magnitude Earthquake):
যদি মাত্রার দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পের কথা বলেন, তাহলে সেটা হলো:
- ১৯৬০ সালের চিলির ভালদিভিয়া ভূমিকম্প (Valdivia Earthquake):
- কবে হয়েছিল: ১৯৬০ সালের ২২শে মে।
- কোথায়: চিলির ভালদিভিয়া।
- মাত্রা: ৯.৫ মাত্রা! যা রেকর্ড করা ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি।
- কেন এত বড়: এই ভূমিকম্পটা এত শক্তিশালী ছিল যে, এর প্রভাবে শুধু চিলি নয়, প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে জাপান, ফিলিপাইন এমনকি হাওয়াইতেও ভয়াবহ সুনামি হয়েছিল। এতে প্রায় ১,৬৫৫ জন মানুষ মারা গিয়েছিল, আহত হয়েছিল অনেকে, আর ২০ লাখের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছিল। যদিও মাত্রা অনেক বেশি ছিল, কিন্তু শানশির মতো এত বেশি মানুষ মারা যায়নি। এর কারণ হলো, এটি তুলনামূলকভাবে কম জনবসতিপূর্ণ এলাকায় হয়েছিল।
এছাড়াও, ২০০৪ সালের ভারত মহাসাগরের ভূমিকম্প আর সুনামির কথা বলা যায়, যেটা ৯.১ থেকে ৯.৩ মাত্রার ছিল এবং ১৪টি দেশে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। এটিও মানব ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে পরিচিত।
‘ভয়াবহ’ ব্যাপারটা আসলে কী মাপকাঠিতে দেখছেন, তার ওপর নির্ভর করে। তবে শানশির ভূমিকম্পের মতো এত বেশি প্রাণহানি হওয়া ঘটনা আর দেখা যায়নি ইতিহাসে।
ভূমিকম্পের পরে বৈদ্যুতিক লাইনে করণীয়?
ভূমিকম্পের পর যখন মাটি কাঁপা থেমে যাবে, তখন সবার আগে আপনার আর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আর এই নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিদ্যুতের লাইন একটা বড় চিন্তার বিষয়।
১. প্রথমেই মেইন সুইচ বন্ধ করুন (যদি নিরাপদে পারেন!):
এটা হলো সবচেয়ে জরুরি কাজ। যদি আপনার মেইন সার্কিট ব্রেকার বা ফিউজ বক্সের কাছাকাছি নিরাপদে পৌঁছাতে পারেন, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুতের মেইন সুইচটা বন্ধ করে দিন।
- কেন করবেন? ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে যেতে পারে, শর্ট সার্কিট হতে পারে বা কোনো যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আগুন লেগে যেতে পারে। মেইন সুইচ বন্ধ করে দিলে এই ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমে যায়।
২. চারপাশে সাবধানে নজর রাখুন:
মেইন সুইচ বন্ধ করার পর, বা যদি মেইন সুইচের কাছে যাওয়া নিরাপদ না হয়, তাহলে খুব সতর্কভাবে চারপাশে দেখুন:
- তার ছিঁড়েছে কিনা: কোথাও বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে ঝুলে আছে কিনা, বা দেয়ালের ভেতর থেকে তার বেরিয়ে এসেছে কিনা, দেখুন।
- স্পার্ক বা আগুনের চিহ্ন: কোথাও স্পার্ক (আগুন জ্বলার মতো ছোট ঝলকানি) দেখছেন কিনা, বা পোড়া গন্ধ পাচ্ছেন কিনা, সেটা খেয়াল করুন। পোড়া গন্ধ পেলে বুঝবেন কোথাও বিদ্যুতের তার গরম হয়ে যাচ্ছে বা পুড়ে যাচ্ছে।
- ভেঙে যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত যন্ত্রপাতি: ঘরে কোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি (যেমন টিভি, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ) পড়ে গিয়ে বা নড়ে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা, তা পরীক্ষা করুন।
৩. যা করবেন না (এটা খুব জরুরি!):
- ছিঁড়ে যাওয়া তারে হাত দেবেন না: যদি বিদ্যুতের কোনো তার ছিঁড়ে মেঝেতে পড়ে থাকে বা ঝুলে থাকে, ভুলেও সেটা ধরতে যাবেন না! বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার মারাত্মক ঝুঁকি থাকে।
- ভেঙে যাওয়া যন্ত্রপাতি ব্যবহার করবেন না: যে যন্ত্রপাতিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো বিদ্যুতের সঙ্গে লাগানো থাকলে সঙ্গে সঙ্গে খুলে ফেলুন এবং ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
- গ্যাসের গন্ধ পেলে সুইচ অন-অফ নয়: যদি আপনার বাড়িতে গ্যাসের গন্ধ পান (ভূমিকম্পের ফলে গ্যাস পাইপ ফেটে যেতে পারে), তাহলে ভুলেও কোনো বিদ্যুতের সুইচ অন-অফ করবেন না! একটা ছোট্ট স্পার্ক থেকেও বড় অগ্নিকাণ্ড হতে পারে।
৪. কখন সাহায্য চাইবেন?
- যদি দেখেন বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে বাইরে পড়ে আছে, বা আপনার বাড়ির ভেতরে বড় ধরনের বৈদ্যুতিক ক্ষতির লক্ষণ দেখছেন, তাহলে নিজে কিছু করতে যাবেন না।
- সঙ্গে সঙ্গে আপনার বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কোম্পানিকে (যেমন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি) ফোন করে জানান।
- কোনো অবস্থাতেই নিজে নিজে বিদ্যুতের তার মেরামত করার চেষ্টা করবেন না। এটা শুধুমাত্র প্রশিক্ষিত ইলেকট্রিশিয়ান বা বিদ্যুৎ কর্মীরাই করতে পারবেন।
মূল কথা হলো, ভূমিকম্পের পর বৈদ্যুতিক লাইনগুলো যেন একটা ‘টাইম বোম’ হয়ে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখা। সতর্কতা আর দ্রুত পদক্ষেপ আপনাকে অনেক বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দেবে।
ভূমিকম্পের সময় জানালা থেকে দূরে থাকতে হয়?
দেখুন, যখন ভূমিকম্প হয়, তখন আমাদের পায়ের নিচের মাটিটা এমন করে কাঁপে যে, পুরো বাড়িটাই দুলে ওঠে, তাই না? আর এই কাঁপুনিটা শুধু বাড়িটাকেই দোলায় না, বাড়ির ভেতরের সব জিনিসপত্রকেও ভীষণভাবে ঝাঁকাতে থাকে।
জানালার কাঁচ জিনিসটা কিন্তু খুব নরম, ভঙ্গুর। যতই মজবুত মনে হোক না কেন, ভূমিকম্পের সময় কাঁচগুলো কিন্তু বেশ বিপদজনক হয়ে ওঠে। যখন প্রচণ্ড ঝাঁকুনি হয়, তখন:
- কাঁচ ভেঙে যেতে পারে: শক্তিশালী কম্পনের ফলে জানালার কাঁচ মুহূর্তেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে আসতে পারে। এই ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলো ব্লেডের মতো ধারালো হয়, যা আপনার শরীর, মুখ বা চোখে মারাত্মক আঘাত করতে পারে। কল্পনা করুন, একটা কাঁচের শার্পনেল আপনার দিকে তেড়ে আসছে!
- ফ্রেম সরে যেতে পারে: শুধু কাঁচ নয়, জানালার পুরো ফ্রেমটাই দুলে গিয়ে দেয়াল থেকে সরে যেতে পারে বা আপনার দিকে ছিটকে আসতে পারে।
- বাইরের জিনিস ভেতরে আসতে পারে: যদি আপনার জানালার বাইরে কিছু পড়ে থাকে, যেমন – কোনো ফুলের টব, সাইনবোর্ড বা অন্য কোনো আলগা জিনিস, সেগুলো ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে ভেঙে বা ছিটকে আপনার জানালার কাঁচ ভেঙে ভেতরে চলে আসতে পারে।
এজন্যই, ভূমিকম্প শুরু হওয়ার সাথে সাথেই যদি আপনি জানালার পাশে থাকেন, তাহলে দ্রুত সেখান থেকে সরে আসুন। জানালার বদলে কোনো মজবুত টেবিল বা ডেস্কের নিচে যান, অথবা কোনো ভেতরের দেয়ালের পাশে বসে পড়ুন। এটাই সবচেয়ে নিরাপদ।
আশা করি, এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছেন যে কেন জানালার কাছ থেকে দূরে থাকাটা আপনার জীবনের জন্য এত জরুরি।
শিশুকে ভূমিকম্পের সময় কী শেখাবেন?
শিশুদেরকে শেখানোর জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হলো এটাকে একটা খেলার মতো করে শেখানো। ওদেরকে ভয় না দেখিয়ে, সহজ সরল ভাষায় আর প্র্যাকটিস করিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে।
১. সেই ম্যাজিক তিনটে কথা: “ড্রপ, কাভার, হোল্ড অন” (নিচু হও, লুকোও, ধরে থাকো)!
শিশুদেরকে বলুন, “যখন পৃথিবীটা হঠাৎ করে রেগে গিয়ে কাঁপতে শুরু করবে, তখন আমাদের এই তিনটে কথা মনে রাখতে হবে:”
- ড্রপ (নিচু হও): “সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ো বা মাটির ওপর শুয়ে পড়ো। দৌঁড়াদৌড়ি করবে না।” (হাত দিয়ে দেখিয়ে দিন কীভাবে হাঁটু গেড়ে বসতে হয়)।
- কাভার (লুকোও): “তারাতারি কোনো শক্ত টেবিল, ডেস্ক বা খাটের নিচে ঢুকে পড়ো। আর তোমার দু’হাত দিয়ে মাথার ওপরের আর পেছনের অংশটা ভালো করে ঢেকে রাখো।” (এটা ওদেরকে দেখিয়ে দিন, কীভাবে টেবিলের নিচে ঢুকে মাথা ঢাকতে হয়)।
- হোল্ড অন (ধরে থাকো): “তুমি যেখানে লুকিয়েছো, সেই টেবিলের পায়া বা কোনো শক্ত অংশ শক্ত করে ধরে থাকো। যতক্ষণ না কাঁপুনি থামছে, ততক্ষণ ওখান থেকে বের হবে না।” (বলুন, “যদি টেবিলটা নড়ে, তুমিও টেবিলের সাথে সাথে সরবে, কিন্তু ওটাকে ছাড়বে না”)।
২. এটাকে একটা খেলার মতো প্র্যাকটিস করুন:
- সপ্তাহে একবার বা মাসে একবার “ভূমিকম্পের খেলা” খেলুন। বলুন, “চলো, আজ আমরা ভূমিকম্পের খেলা খেলবো! যখন আমি ‘ভূমিকম্প’ বলবো, তখন তোমরা সবাই ‘ড্রপ, কাভার, হোল্ড অন’ করবে!”
- ওদেরকে দেখিয়ে দিন কোথায় নিরাপদ জায়গা (যেমন: স্টাডি টেবিলের নিচে, শক্ত খাটের নিচে) আর কোথায় নিরাপদ নয় (যেমন: জানালার পাশে, লম্বা আলমারির পাশে, দরজার ফ্রেমের নিচে)।
৩. কেন দূরে থাকবে, বুঝিয়ে বলুন:
- জানালার কথা বলুন: “জানালার কাঁচ খুব সহজে ভেঙে যায়। যখন পৃথিবী কাঁপে, কাঁচগুলো ভেঙে আমাদের গায়ে এসে লাগতে পারে। তাই জানালা থেকে দূরে থাকতে হয়।”
- ভারী জিনিসের কথা বলুন: “লম্বা আলমারি বা শেলফে অনেক ভারী জিনিস থাকে, যেগুলো পড়ে যেতে পারে। তাই ওগুলোর কাছ থেকেও দূরে থাকতে হবে।”
৪. স্কুলে বা বাইরে থাকলে কী করবে?
- স্কুলে থাকলে: ওদেরকে শেখান যে স্কুলে থাকলে টিচার যা বলেন, সেটাই ওদেরকে মানতে হবে। টিচাররা সাধারণত ওদেরকে ডেস্কের নিচে যেতে বলবেন বা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাবেন।
- বাইরে থাকলে: বলুন, “যদি খেলার মাঠে থাকো, তাহলে খোলা জায়গায় গিয়ে নিচু হয়ে বসে পড়ো। কোনো বিল্ডিং, গাছ বা বিদ্যুতের খুঁটির নিচে যাবে না।”
৫. আশ্বাস দিন, ভরসা দিন:
- শিশুদেরকে বলুন, “আমরা (মা-বাবা বা বড়রা) সবসময় তোমার পাশে আছি। আমরা তোমাকে রক্ষা করবো।”
- ওদেরকে বলুন, “ভূমিকম্পের সময় একটু ভয় লাগা স্বাভাবিক। কিন্তু যদি তুমি এই নিয়মগুলো মানো, তাহলে তুমি নিরাপদে থাকবে।”
- ভূমিকম্পের ভয়াবহতা নিয়ে ওদের সাথে খুব বেশি কথা বলবেন না, এতে ওরা ভয় পেতে পারে। শুধু ওদেরকে নিরাপদে থাকার উপায়গুলো শেখান।
শিশুদেরকে যত বেশি প্র্যাকটিস করাবেন, ওরা তত সহজে ব্যাপারটা শিখে যাবে এবং জরুরি মুহূর্তে সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে। এটাই ওদের জন্য সবচেয়ে বড় সুরক্ষা।
এই সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানুন : ভূমিকম্প
আপনি চাইলে আমার এই ব্লগটি পড়তে পারেন : নারী কবিতার মূলভাব