ধর্ম

ঈশ্বরের মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানোর কারণ

মোহাম্মদ বাইতুল্লাহ। ঢাকাপোস্ট ডট নেট।


মানুষের ঈশ্বরের মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানোর কারণ পেছনে অনেক থাকতে পারে। এটি একটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং জটিল প্রক্রিয়া, যা বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, চিন্তাভাবনা এবং পরিবেশের প্রভাবে ঘটে। এখানে কিছু সাধারণ কারণ আলোচনা করা হলো:

১. ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও ট্র্যাজেডি

অনেক সময় মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া মারাত্মক ট্র্যাজেডি বা দুর্ভাগ্য ঈশ্বরের প্রতি তাদের বিশ্বাস টলিয়ে দিতে পারে। যেমন:

  • প্রিয়জনের মৃত্যু: যদি কোনো ব্যক্তি তার পরিবারের সদস্য বা খুব কাছের কাউকে হারান, বিশেষ করে যদি তা অপ্রত্যাশিত বা মর্মান্তিক হয়, তখন তাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, “ঈশ্বর যদি থাকেন এবং দয়ালু হন, তাহলে এমনটা কেন ঘটলো?”
  • প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রোগ: ভয়াবহ বন্যা, ভূমিকম্প, বা দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার মতো ঘটনাগুলো মানুষকে ঈশ্বরের ক্ষমতা বা উপকারের বিষয়ে সন্দিহান করে তোলে। তারা ভাবতে পারে, “কেন ঈশ্বর এমন দুর্দশা অনুমোদন করেন?”
  • অবিচার ও দুর্ভোগ: বিশ্বে যখন ব্যাপক অন্যায়, যুদ্ধ, দারিদ্র্য বা শিশুদের দুর্ভোগ দেখা যায়, তখন মানুষ ভাবতে শুরু করে, “কেন একজন সর্বশক্তিমান ও দয়ালু ঈশ্বর এই অন্যায় বন্ধ করেন না?”

২. যৌক্তিকতা ও বিজ্ঞান

বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে অনেক মানুষ যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার দিকে ঝুঁকছেন।

  • ধর্মীয় গ্রন্থের বৈজ্ঞানিক অসঙ্গতি: যখন ধর্মীয় গ্রন্থগুলিতে বর্ণিত ঘটনাগুলি বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক মনে হয় (যেমন সৃষ্টির বর্ণনা), তখন কিছু মানুষ তাদের বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
  • প্রমাণ ও পর্যবেক্ষণ: বিজ্ঞান প্রমাণ এবং পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে। ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ না থাকায়, কিছু মানুষ বিশ্বাসকে যুক্তিহীন মনে করে।
  • দার্শনিক প্রশ্ন: কিছু মানুষ ঈশ্বরের অস্তিত্ব, তার সর্বশক্তিমানতা, সর্বজ্ঞতা এবং পরোপকারের ধারণার মধ্যে দার্শনিক অসঙ্গতি খুঁজে পায়। যেমন, “যদি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান হন এবং সব জানেন, তাহলে তিনি কেন মন্দকে থাকতে দেন?”

৩. নৈতিকতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং তাদের অনুসারীদের কিছু আচরণ বা বিশ্বাস মানুষকে ধর্ম থেকে দূরে ঠেলে দিতে পারে:

  • ধর্মীয় ভণ্ডামি: যখন কোনো ধর্মীয় নেতা বা প্রতিষ্ঠানকে ভণ্ড, দুর্নীতিগ্রস্ত বা অনৈতিক কাজ করতে দেখা যায়, তখন তা মানুষের বিশ্বাসকে ভেঙে দিতে পারে।
  • ধর্মীয় সংঘাত ও সহিংসতা: ইতিহাসের পাতা উল্টালে বা বর্তমান বিশ্বে যখন ধর্মের নামে সংঘাত, যুদ্ধ বা ঘৃণা দেখা যায়, তখন অনেকে ধর্মকে শান্তির বদলে বিভেদের কারণ মনে করে।
  • নৈতিকতার সাথে ধর্মীয় বিধানের সংঘাত: কিছু মানুষ মনে করে যে, কিছু ধর্মীয় বিধান বা নৈতিকতা আধুনিক সমাজের মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, যা তাদের বিশ্বাসে চিড় ধরায়।

৪. ব্যক্তিগত পরিবর্তন ও স্বাধীনতা

অনেক সময় মানুষের ব্যক্তিগত বৃদ্ধি, নতুন অভিজ্ঞতা এবং জীবনবোধের পরিবর্তন বিশ্বাসের ওপর প্রভাব ফেলে:

  • শিক্ষাদীক্ষা ও জ্ঞানার্জন: উচ্চশিক্ষা এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয়, যা তাদের পুরোনো বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
  • স্বাধীন চিন্তা: যারা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পছন্দ করে, তারা কোনো নির্দিষ্ট dogma বা মতবাদের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বাস স্থাপন করতে দ্বিধা করে। তারা নিজেরাই জীবনের অর্থ খুঁজে বের করতে চায়।
  • ব্যক্তিগত আত্ম-অনুসন্ধান: কিছু মানুষ নিজেদের ভেতরের সত্যকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করে এবং এই প্রক্রিয়ায় তারা প্রচলিত ধর্মীয় কাঠামোর বাইরে চলে আসতে পারে।

৫. প্রভাবমুক্ত পরিবেশ

কিছু মানুষ এমন পরিবেশে বড় হয় যেখানে ধর্মের কোনো প্রভাব নেই, অথবা তাদের পরিবার বা বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই অবিশ্বাসী। এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে তাদের মনে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস গড়ে তোলার কোনো প্রবণতা নাও থাকতে পারে।

মূলত, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারানোটা কোনো একক ঘটনার ফল নয়, বরং এটি প্রায়শই উপরের কারণগুলির একটি জটিল মিশ্রণ এবং দীর্ঘমেয়াদী চিন্তাভাবনার ফসল। এটি মানুষের জীবনের একটি স্বাভাবিক অংশ হতে পারে, যেখানে তারা নিজেদের বিশ্বাস এবং বিশ্বকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে।

ঈশ্বরের মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানোর কারণ
একটি যুক্তিবাদী সমাজ

আমার মনে হয় বিষয়টি একটি গল্প আকারে তুলে ধরলে আমাদের বুঝতে সুবিধা হবে, যেমন:

ধূসর ভোরের ইতিকথা:

মোহাম্মদ বাইতুল্লাহ



আকাশে তখনো পুরোপুরি আলো ফোটেনি। আবছা আঁধারে গাঢ় নীল আর ফিকে সাদার মিশেলে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। জনপদের আলস্য তখনও ভাঙেনি, শুধু দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে ফজর আজানের সুমধুর সুর। ফজরের আজান, সুমনের কাছে বরাবরই এক শীতল পরশ এনে দিতো। সে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুনতো, তারপর বিছানা ছেড়ে ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়াতো জানালার ধারে। ছোটবেলায় মা তাকে শিখিয়েছিলেন, দিনের শুরুটা ঈশ্বরের নামে করলে নাকি দিনটা বরকতময় হয়। সুমন বরাবরই মায়ের বাধ্য ছেলে ছিলো।

কিন্তু সেদিন, সে জানালার পাশে দাঁড়িয়েছিলো অন্য এক কারণে। আজানের সুর তার কানে বিঁধছিল কাঁটার মতো, আর বুকটা জুড়ে ছিলো এক চাপা পাথর। গত রাত থেকে সে এক মুহূর্তের জন্যও চোখ বন্ধ করতে পারেনি। শুধু একটা দৃশ্যই তার চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছিলো— তার ছোট্ট বোন, তিন বছরের অহনা, হাসপাতালের বিছানায় নিথর শুয়ে আছে। ডাক্তাররা নিরুপায় মুখ করে জানিয়েছে, “আমরা সব চেষ্টা করেছি, সুমন। ওর ফুসফুস অতিরিক্ত সংক্রমিত হয়ে গিয়েছিল। বাঁচানো গেল না।”

সুমন দাঁতে দাঁত চেপেছিলো। বাঁচানো গেল না? তাহলে এত প্রার্থনা কেন করলো সে? এত মানত কেন করলো তার মা? বাবা সারারাত ধরে আল্লাহর কাছে হাত তুলেছেন, চোখে পানি নিয়ে মুনাজাত করেছেন। পাড়ার ইমাম সাহেবও এসে অহনার দ্রুত আরোগ্য কামনা করে দোয়া করে গেছেন। সবাই বলছিল, আল্লাহ মহান, তিনি চাইলে সবই সম্ভব। তাহলে কেন সম্ভব হলো না? কেন অহনা মারা গেল?


সেদিন সকালটা সুমনের জীবনের সবচেয়ে ধূসর সকাল ছিলো। অহনার দাফন হলো। ছোট্ট একটা কবর, মাটি দিয়ে ঢাকা। তার মা নির্বাক হয়ে বসেছিলেন কবরের পাশে, যেন প্রাণহীন এক মূর্তি। বাবা বারবার ওপরে তাকিয়ে ফিসফিস করে কী যেন বলছিলেন, হয়তো আল্লাহর কাছে আরও কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন, বা হয়তো ক্ষমা চাইছিলেন নিজের কোনো ভুলের জন্য। সুমন কিন্তু ওপরে তাকাতে পারলো না। তার চোখে শুধু অহনার হাসি মুখটা ভাসছিল। অহনা যখন খেলতো, তার টোল পড়া গালে একটা গভীর হাসি ফুটে উঠতো। সে হাসিতে যেন পুরো ঘরটা আলোকিত হয়ে যেত। সেই আলো আজ কোথায়?

কবরের দিকে তাকিয়ে সুমনের মনে হলো, ঈশ্বর বলে যদি কেউ থাকেন, তিনি কেন এত নিষ্ঠুর হতে পারেন? তিন বছরের নিষ্পাপ একটি শিশুকে তিনি কেন কেড়ে নিলেন? সে তো কারো কোনো ক্ষতি করেনি। কোনো পাপ করেনি। তাহলে কেন? এই ‘কেন’ প্রশ্নটা সুমনের মাথার ভেতরে পোকার মতো কুটকুট করে কাটছিল।

প্রথম কয়েকটা দিন সে কাউকে কিছু বলেনি। নিজের ভেতরেই গুটিয়ে রেখেছিলো এই প্রশ্নগুলো। নামাজ পড়ার সময় সে শুধু শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো, মুখে কোনো শব্দ আসতো না। মায়ের পীড়াপীড়িতে জুম্মার নামাজে গেলেও তার মন কিছুতেই বসতো না। ইমাম সাহেব যখন ঈশ্বরের দয়া আর মহত্বের কথা বলতেন, সুমনের মনে হতো সেগুলো শুধুই ফাঁকা বুলি। যদি ঈশ্বর এতই দয়ালু হন, তাহলে কেন পৃথিবী জুড়ে এত দুঃখ, কষ্ট আর অবিচার? কেন এত শিশু অপুষ্টিতে ভোগে, কেন এত মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যায়? কেন অহনার মতো নিষ্পাপ একটি শিশুকেও বাঁচানো গেল না?


সুমনের বয়স তখন পনেরো। ক্লাস নাইনে পড়ে। বন্ধুদের সাথে বিকেলে ফুটবল খেলতে যেত, কিন্তু এখন আর যায় না। বইয়ের পাতায় মন বসতো না। আগে নিয়মিত কোরআন পড়তো, হাদিস পড়তো, কিন্তু এখন বইগুলো হাতের কাছে পেলেই এক অদ্ভুত বিরক্তি আসতো। সে বুঝতে পারছিলো, তার ভেতরটা যেন বদলে যাচ্ছে। আগে সে যা বিশ্বাস করতো, এখন আর তা পারছে না।

একদিন তার এক পুরোনো শিক্ষক, আমিন স্যার, তাদের বাড়িতে এলেন। আমিন স্যার ছিলেন বিজ্ঞানপ্রেমী এবং মুক্তমনা একজন মানুষ। তিনি সুমনের বাবাকে সান্ত্বনা দিতে এসেছিলেন। সুমন তখন পাশের ঘরে বসে একটা বিজ্ঞানের বই পড়ছিল। বইটা ছিলো মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে। বিগ ব্যাং, তারাদের জন্ম, গ্যালাক্সির বিবর্তন— সব কিছুই সেখানে সুবিন্যস্তভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কোথাও কোনো অলৌকিকতার চিহ্ন নেই।

আমিন স্যার যখন সুমনের বাবার সাথে কথা বলছিলেন, সুমন শুনতে পাচ্ছিল, তার বাবা বলছেন, “আল্লাহর ইচ্ছায় সব হয়, স্যার। তিনিই আমাদের ধৈর্য দিয়েছেন।”

আমিন স্যার মৃদু হেসে বললেন, “ধৈর্য আমাদের নিজেদেরই তৈরি করে নিতে হয়, হাসান সাহেব। প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে চলে। এখানে ঈশ্বরের ইচ্ছার চেয়েও কার্যকারণ সম্পর্ক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

সুমন চমকে উঠলো। তার বাবা কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললেন, “কিন্তু স্যার, সব তো তাঁরই সৃষ্টি!”

আমিন স্যার বললেন, “আমরা যা দেখি, যা অনুভব করি, তা হলো প্রাকৃতিক নিয়ম। বিজ্ঞান এই নিয়মগুলোকেই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। এই মহাবিশ্ব তার নিজের নিয়মেই চলছে। চাঁদ সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, গাছপালা সালোকসংশ্লেষণ করছে, রোগজীবাণু রোগ ছড়াচ্ছে – এসবের পেছনে অদৃশ্য কোনো শক্তির হাত আছে, নাকি এগুলো নিছকই প্রকৃতির নিয়ম? এটা নিয়ে বিতর্ক আছে।”

সুমন মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। আমিন স্যার যেন তার ভেতরের প্রশ্নগুলোর প্রতিধ্বনি করছিলেন। স্যার চলে যাওয়ার পর সুমন সাহস করে বাবাকে প্রশ্ন করলো, “বাবা, যদি সবকিছু প্রাকৃতিক নিয়মে চলে, তাহলে আমরা কেন আল্লাহর কাছে চাইবো?”

বাবা সুমনের দিকে অবাক হয়ে তাকালেন। “এটা কেমন কথা, সুমন? আল্লাহ তো সবকিছুর স্রষ্টা। তাঁর কাছে না চাইলে আর কার কাছে চাইবো?”

সুমন আর কিছু বললো না। সে বুঝতে পারলো, বাবার সাথে এই বিষয়ে তার মতের মিল হবে না।


এরপর থেকে সুমন আরও বেশি করে বিজ্ঞান এবং দর্শনের বই পড়া শুরু করলো। সে ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়লো, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ পড়লো, হকিং-এর মহাবিশ্ব সম্পর্কে ধারণা নিলো। যত সে জ্ঞান অর্জন করতে লাগলো, তত তার কাছে ঈশ্বরের ধারণাটা অস্পষ্ট হতে লাগলো। যদি সবকিছুর পেছনে প্রাকৃতিক নিয়ম কাজ করে, তাহলে ঈশ্বরের ভূমিকাটা কোথায়?

সে দেখলো, এই পৃথিবীতে কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই। একজন ভালো মানুষও অসুস্থ হয়, একজন খারাপ মানুষও সুস্থ থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদি ঈশ্বর থাকেন, তাহলে কেন তিনি তার বিশ্বাসীদের রক্ষা করেন না? কেন একজন ধার্মিক মানুষও চরম দারিদ্র্যের শিকার হন, আর একজন দুর্নীতিবাজ মানুষও বিলাসবহুল জীবন যাপন করে?

একদিন সে তার মাকে দেখতে পেলো জায়নামাজে বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন। মা তখনও অহনার শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তিনি বিড়বিড় করে বলছিলেন, “আল্লাহ, তুমি আমাদের ক্ষমা করো। আমাদের অহনাকে ফিরিয়ে দাও।”

সুমনের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সে মায়ের পাশে গিয়ে বসলো।

“মা, তুমি এখনো কাঁদছো?”

মা চোখ মুছে বললেন, “কী করবো বাবা? অহনাকে ছাড়া আমার সব শূন্য লাগে। আল্লাহর কাছে চাইছি, যেন সে জান্নাতে ভালো থাকে।”

সুমন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “কিন্তু মা, যদি জান্নাত বলে কিছু না থাকে?”

মা চমকে উঠলেন। “এ কি কথা বলছিস, বাবা? নাউজুবিল্লাহ! এমন কথা বলতে নেই।”

“মা, তুমি কি কখনও জান্নাত দেখেছো? কেউ কি দেখেছে?”

মা হতবাক হয়ে সুমনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। “এসব শয়তানের প্ররোচনা, বাবা! তুই পথভ্রষ্ট হচ্ছিস।”

সুমন উঠে দাঁড়ালো। সে বুঝতে পারলো, মায়ের সাথে এই কথা চালিয়ে যাওয়া অর্থহীন। মা সারাজীবন ধরে যে বিশ্বাসে বড় হয়েছেন, সেটা হঠাৎ করে ভাঙতে পারবে না।


সুমন কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। সে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়ছিল। তার চারপাশে তখন যুক্তিবাদী বন্ধু-বান্ধব, যারা যুক্তির ওপর নির্ভর করে বিশ্বকে বুঝতে চায়। তাদের সাথে আলোচনা করে সুমনের ধারণাগুলো আরও স্পষ্ট হলো।

তারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক করতো। কেউ কেউ বলতো, মহাবিশ্বের সৃষ্টি এতটাই জটিল যে এর পেছনে একজন সৃষ্টিকর্তা থাকা উচিত। অন্যরা যুক্তি দিতো, প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং মহাবিশ্বের নিজস্ব নিয়মেই এই জটিলতা তৈরি হয়েছে। জীবন নিজেই নিজেকে বিকশিত করেছে, কোনো ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই।

সুমনের মনে তখন আর কোনো প্রশ্ন ছিলো না। সে বুঝতে পেরেছিলো, ঈশ্বর বলে কোনো সত্তা নেই। তার ভেতরের সেই বিশ্বাস, যা ছোটবেলা থেকে তার শিরায় শিরায় মিশে ছিলো, তা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে গেছে। একসময় সে রাতের আঁধারে আল্লাহর কাছে হাত তুলে প্রার্থনা করতো, এখন সে বিজ্ঞানাগারে বসে মহাবিশ্বের রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করে।

কিন্তু এই বিশ্বাস হারানোর পেছনে কোনো আনন্দ ছিলো না, ছিলো এক গভীর শূন্যতা। যখন মানুষ কোনো কিছুতে বিশ্বাস করে, তখন তার জীবনে একটা আশ্রয় থাকে, একটা নির্ভরতা থাকে। সুমনের সেই আশ্রয়টা ভেঙে গিয়েছিল। সে এখন অনুভব করতো, মানুষের জীবনটা একটাই। এর কোনো পুনর্জন্ম নেই, কোনো পরকাল নেই। এই জীবনেই সব অর্জন করতে হবে, এই জীবনেই সব ভালোবাসতে হবে, এই জীবনেই সব দুঃখ মোকাবেলা করতে হবে।

সে দেখলো, অহনার মৃত্যু তাকে নাস্তিক্যবাদের পথে নিয়ে এসেছে, কিন্তু সেই পথটা মসৃণ ছিল না। সে এখনও মাঝেমধ্যে মায়ের জায়নামাজের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার মনে হয়, মানুষের বিশ্বাসগুলো হয়তো এক ধরনের সান্ত্বনা। হয়তো এই সান্ত্বনাটুকু না থাকলে পৃথিবীটা আরও কঠিন হয়ে যেত।


আজ সুমন একজন সফল বিজ্ঞানী। সে মহাকাশ গবেষণা নিয়ে কাজ করে। সে জানে, এই সুবিশাল মহাবিশ্বে মানুষ কত ক্ষুদ্র। কোনো অদৃশ্য শক্তি নয়, মানুষের জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং নিজেদের প্রচেষ্টাই এই বিশ্বকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

একদিন সে একটি সেমিনারে বক্তব্য রাখছিল। সেখানে একজন বৃদ্ধা উঠে তাকে প্রশ্ন করলেন, “ডাক্তার সুমন, আপনি কি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না?”

সুমন হাসলো। তার হাসিটা ছিল শান্ত এবং দৃঢ়।

“আমি প্রাকৃতিক নিয়মে বিশ্বাস করি, ম্যাডাম। আমি বিশ্বাস করি মানুষের ক্ষমতায়, বিজ্ঞানের শক্তিতে। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ নিজেই নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারে, কোনো অলৌকিক শক্তির ওপর ভরসা না করে।”

সেমিনারের পর সুমন যখন বাইরে এলো, তখন রাতের আকাশ তারার মেলায় ভরে গেছে। সে আকাশের দিকে তাকালো। কোনো প্রার্থনা নয়, কোনো ভক্তি নয়, শুধু অসীম এক মুগ্ধতা। সে দেখলো, এই বিশাল মহাবিশ্ব তার নিজের নিয়মেই চলছে, কোনো অদৃশ্য হাতের ইশারায় নয়। আর এই নিয়মের সৌন্দর্যটাই তার কাছে সবচেয়ে বড় বিস্ময়। অহনার মৃত্যু তাকে যে পথে এনেছে, সেই পথে সে আর একা নয়। তার মতো আরও অসংখ্য মানুষ এই প্রাকৃতিক নিয়মের দিকে তাকিয়ে বিস্ময় খুঁজে নেয়, এবং নিজের জীবনের অর্থ খুঁজে পায় নিজেদেরই কর্মে, ভালোবাসায় ও সংগ্রামে।

ঈশ্বরের মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানোর কারণ
একটি কুসংস্কার মুক্ত সমাজ যেমন হতে পারে

ঈশ্বরের মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানোর আরও একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার, চলুন দেখি বিষয়টি কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।


ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার:

ধর্ম মানব সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি মানুষকে নৈতিকতা শেখায়, সম্প্রদায়ের বন্ধন তৈরি করে এবং জীবনের অর্থ খুঁজতে সাহায্য করে। তবে, যখন ধর্ম গোঁড়ামি (Fanaticism) এবং কুসংস্কারে (Superstition) পরিণত হয়, তখন তা সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং কুসংস্কারের সমালোচনা করার অর্থ ধর্মের মূল ভিত্তি বা বিশ্বাসকে আক্রমণ করা নয়, বরং এর সেই দিকগুলিকে প্রশ্ন করা যা মানুষের যুক্তি, অগ্রগতি এবং মানবিকতাকে বাধাগ্রস্ত করে।


ধর্মীয় গোঁড়ামি

ধর্মীয় গোঁড়ামি হলো নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে চূড়ান্ত সত্য এবং একমাত্র সঠিক পথ বলে মনে করা। এর ফলে অন্য ধর্ম বা ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা এবং এমনকি সহিংসতাও দেখা যেতে পারে।

সমালোচনার কারণ:

  • অসহিষ্ণুতা ও বিভেদ: গোঁড়ামি মানুষকে ‘আমরা বনাম ওরা’ মানসিকতায় বিভক্ত করে। নিজেদের বিশ্বাসকে শ্রেষ্ঠ মনে করে অন্যদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ায়, যা সমাজে বিভেদ তৈরি করে। ইতিহাসের বেশিরভাগ ধর্মীয় সংঘাতের মূলে রয়েছে এই গোঁড়ামি।
  • যুক্তির অবমাননা: গোঁড়ামি প্রায়শই যুক্তির পথ রুদ্ধ করে দেয়। গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন ব্যক্তিরা কোনো কিছুকে প্রশ্ন করতে বা ভিন্নভাবে চিন্তা করতে নারাজ হয়। তারা নিজেদের বিশ্বাসকে এতটাই আঁকড়ে ধরে যে, বিজ্ঞান, প্রমাণ বা যুক্তির কোনো স্থান সেখানে থাকে না। এর ফলে সমাজের অগ্রগতি ব্যাহত হয়।
  • সহিংসতা ও সন্ত্রাস: চরম পর্যায়ে ধর্মীয় গোঁড়ামি সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিতে পারে। ধর্মের নামে মানুষ খুন করা, নির্যাতন করা বা সম্পদ ধ্বংস করাকে তারা নিজেদের ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করে। ধর্মীয় উগ্রবাদ হলো গোঁড়ামির সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ।
  • ব্যক্তিগত স্বাধীনতার লঙ্ঘন: গোঁড়া ধর্মীয় নেতারা বা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়শই মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। পোশাক, জীবনযাপন, শিক্ষা বা পেশার মতো ব্যক্তিগত পছন্দগুলোকেও তারা ধর্মীয় অনুশাসনের দোহাই দিয়ে সীমাবদ্ধ করে দেয়, যা ব্যক্তির বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
  • মানবতার অবমাননা: যখন ধর্ম মানবতাকে ছাপিয়ে যায়, তখন তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। গোঁড়ামি প্রায়শই নারী-পুরুষ, জাতি বা ভিন্ন বিশ্বাসের মানুষের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণকে উৎসাহিত করে, যা মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থী।

কুসংস্কার

কুসংস্কার হলো এমন অলীক বিশ্বাস যা যুক্তি বা বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং ভয়, অজ্ঞতা বা ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে অনেক কুসংস্কারের জন্ম হয়।

সমালোচনার কারণ:

  • ভয় ও শোষণ: কুসংস্কার মানুষকে অহেতুক ভয় দেখায়। অমঙ্গল, অশুভ শক্তি বা ঈশ্বরের রোষের ভয় দেখিয়ে এক শ্রেণির মানুষ অন্যদের শোষণ করে। তাবিজ, কবচ, ঝাড়ফুঁক বা তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতার মাধ্যমে মানুষকে ঠকানো হয়।
  • অর্থনৈতিক ক্ষতি: কুসংস্কারের কারণে মানুষ অর্থ ও সম্পদ নষ্ট করে। রোগের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ‘তান্ত্রিক’ বা ‘ওঝা’-এর কাছে যায়, যেখানে বিপুল অর্থ ব্যয় করে ফলস্বরূপ আরও বেশি অসুস্থ হয়। ফসলের ভালো ফলনের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বাদ দিয়ে ‘মাজার’-এ টাকা ঢালে।
  • অগ্রগতির পথে বাধা: কুসংস্কার সমাজের অগ্রগতিকে থামিয়ে দেয়। যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ‘ঈশ্বরের গজব’ বলে ব্যাখ্যা করা হয়, তখন তার বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধান বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা কমে যায়। শিক্ষা ও সচেতনতা বিকাশে কুসংস্কার একটি বড় বাধা।
  • স্বাস্থ্য ঝুঁকি: অনেক সময় কুসংস্কারের কারণে মানুষ গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে। যেমন, বিজ্ঞান-সম্মত টিকাকে অস্বীকার করা বা রোগ হলে কুসংস্কারের আশ্রয় নেওয়া। এর ফলে preventable (প্রতিরোধযোগ্য) রোগেও অনেক মানুষ মারা যায়।
  • যুক্তিবুদ্ধির বিকাশ ব্যাহত: কুসংস্কার শিশুদের মনেও বিরূপ প্রভাব ফেলে। ছোটবেলা থেকে কুসংস্কারে বিশ্বাস করতে শেখানো হলে তাদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং যুক্তিবুদ্ধির বিকাশ ব্যাহত হয়।

উপসংহার

ধর্ম, যখন তার মূল বার্তা – শান্তি, ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং নৈতিকতার ওপর জোর দেয়, তখন তা মানুষের জন্য কল্যাণকর। কিন্তু যখন তা গোঁড়ামি এবং কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়, তখন তা সমাজের জন্য এক বিষাক্ত রূপ ধারণ করে। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের সমালোচনা করা মানেই ধর্মকে বাতিল করা নয়, বরং ধর্মকে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং মানবিক মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করার একটি প্রচেষ্টা। আমাদের উচিত যুক্তি, বিজ্ঞান এবং মানবতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি সহনশীল ও প্রগতিশীল সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে বিশ্বাসের নামে কোনো শোষণ বা বিভেদ থাকবে না।

চলুন এবার এই বিষয়টিও গল্প আকারে ভেবে দেখি কেমন হতে পারে?


অন্ধ ভক্তির দেয়াল

মোহাম্মদ বাইতুল্লাহ

আকাশ তখনো তার তারাদের উৎসব শেষ করেনি, কিন্তু মজনু মিয়ার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আজানের আগেই। তার অভ্যাস, ফজরের অনেক আগে উঠে অজু করে জায়নামাজে বসা। গ্রামের সবাই তাকে পরহেজগার মানুষ হিসেবে চেনে। তার কথায়, চালচলনে, পোশাকে— সবখানেই একনিষ্ঠ ভক্তির ছাপ। লোকে বলে, মজনু মিয়ার মতো আল্লাহভীরু মানুষ এ তল্লাটে বিরল।

আজকের সকালটা অবশ্য অন্যদিনের মতো ছিল না। বুকের ভেতর কেমন একটা চাপ, অস্থিরতা। গত রাতে স্বপ্ন দেখেছে, তার ছোট ছেলে, আট বছরের শামীম, ছটফট করছে জ্বরে। অথচ শামীম ভালোই আছে, দিব্যি খেলছে, পড়াশোনা করছে। কিন্তু স্বপ্নটা কেন এল? মজনু মিয়ার মন কু ডাকছে। তিনি মনে মনে দোয়া দরুদ পড়লেন, আল্লার কাছে আশ্রয় চাইলেন সব অমঙ্গল থেকে।

নামাজ শেষ করে মজনু মিয়া উঠলেন না। জায়নামাজেই বসে দীর্ঘ সময় ধরে মোনাজাত করলেন। তার বিশ্বাস, আল্লাহর কাছে চাওয়া কখনো বিফলে যায় না।


বিকালে শামীম যখন স্কুল থেকে ফিরল, মজনু মিয়ার চোখ কপালে। ছেলের মুখে বসন্তের গুটি। সারা মুখ, গা ভরে উঠেছে ফোসকায়। মজনু মিয়ার স্ত্রী, সালেহা, চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। “হায় আল্লাহ! এ কী হলো আমার ছেলের!”

মজনু মিয়া স্ত্রীর দিকে কঠোর চোখে তাকালেন। “চুপ করো! আল্লার ওপর ভরসা রাখো। তিনিই সব ভালো করবেন।”

সালেহা বললেন, “ডাক্তার দেখাবে না?”

মজনু মিয়া হাত নেড়ে বললেন, “বসন্ত দেবীর খেলা। ডাক্তার এখানে কী করবে? এটা তো আর সাধারণ জ্বর সর্দি নয়। পীর সাহেব বলেছেন, এমন রোগ হলে জলপড়া দিতে হয় আর কিছু নিয়ম মানতে হয়। এসব ডাক্তারি ওষুধে কাজ হয় না, বরং ক্ষতি হতে পারে।”

গ্রামে ওঝা পীরদের বেশ প্রভাব ছিল। মজনু মিয়া নিজে তাদের ওপর অগাধ বিশ্বাস রাখতেন। তিনি ছুটে গেলেন গ্রামের পীর সাহেবের কাছে। পীর সাহেব গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ শামীমের দিকে তাকিয়ে একটা জলপড়া দিলেন, আর কিছু লতাপাতা এনে মাদুলি বানিয়ে পরিয়ে দিতে বললেন। বললেন, “বসন্ত হলে গরম পানি ছোঁয়ানো যাবে না, ডিম খাওয়া যাবে না, মাছ খাওয়া যাবে না। আর ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। সাত দিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে, আল্লাহর রহমতে।”

মজনু মিয়া অক্ষরে অক্ষরে সব মেনে চললেন। শামীমের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, সে কেবল ছটফট করছে। সালেহা চেষ্টা করলেন তাকে একটু ঠান্ডা জল দিয়ে মুছিয়ে দিতে, কিন্তু মজনু মিয়া বাধা দিলেন। “পীর সাহেব মানা করেছেন। বসন্তের গুটি শুকিয়ে যাবে, তখন সব ঠিক হবে।”

কিন্তু সাত দিন পার হয়ে গেল, শামীমের অবস্থার কোনো উন্নতি হলো না। বরং গুটিগুলো আরও বড় হলো, শরীরের তাপমাত্রা আরও বেড়ে গেল। শামীম কথা বলতে পারছিল না, শুধু ক্ষীণভাবে কাতরাচ্ছিল। সালেহা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “মজনুর বাপ, ছেলেটা তো আর সহ্য করতে পারছে না। ওকে ডাক্তার দেখাও!”

মজনু মিয়া তখনো অটল। “না, না! ডাক্তার কী করবে? এটা তো দেবীর খেলা! হয়তো আমাদের দোয়ায় কোনো ত্রুটি হচ্ছে। আরও বেশি করে দোয়া করো। পীর সাহেবকে আবার ডাকি।”

পীর সাহেব আবার এলেন। এবার তিনি আরও কঠোর হলেন। “তোমরা নিশ্চয়ই কোনো পাপ করেছো, যার জন্য দেবী রুষ্ট হয়েছেন। আরও বেশি করে ইবাদত করো, দান খয়রাত করো। আর এই মাদুলিটা নতুন করে বানিয়ে নাও।”

মজনু মিয়া সবকিছু করলেন। কিন্তু শামীমের অবস্থা প্রতি মুহূর্তে খারাপ হতে লাগল। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, শরীর নীল হয়ে আসছে। দশ দিনের মাথায় শামীম নিথর হয়ে গেল।

মজনু মিয়া পাথরের মতো বসে রইলেন। তার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানিও পড়ল না। সালেহা ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন। মজনু মিয়ার মনে তখন একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল, “কেন? কেন এমন হলো? আমি তো সব করেছি! সব নিয়ম মেনেছি! পীর সাহেবের কথা শুনেছি! তাহলে কেন আল্লাহ আমার ছেলেকে ফিরিয়ে নিলেন না?”


শামীমের মৃত্যুর পর মজনু মিয়া বদলে গেলেন। তার ভেতরটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। তিনি আর ফজরের আগে উঠতেন না, নামাজেও মন বসতো না। তার ভেতরের ঈশ্বরভক্তি, পীর সাহেবদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস— সব যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল।

গ্রামের মানুষ ফিসফিস করতো, “মজনু মিয়াকে শয়তানে ধরেছে। ছেলের শোকে মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”

আগের মতো কেউ তার কাছে এসে ধর্মীয় পরামর্শ চাইতো না। মজনু মিয়া যেন একঘরে হয়ে গেলেন।

একদিন গ্রামের এক তরুণ ডাক্তার, রফিক, মজনু মিয়ার কাছে এলেন। রফিক শহরে পড়াশোনা করে গ্রামে নতুন ডাক্তারখানা খুলেছেন। তিনি শামীমের খবর শুনেছিলেন।

“মজনু চাচা, আমি জানি আপনি খুব কষ্টে আছেন। তবে আমার একটা কথা বলার আছে।”

মজনু মিয়া উদাস দৃষ্টিতে তাকালেন। “বলো, বাবা।”

রফিক বললেন, “বসন্তের গুটি বা স্মলপক্স এখন আর প্রাণঘাতী নয়, যদি সঠিক চিকিৎসা করা হয়। ভ্যাকসিন আছে, আর যদি হয়েও যায়, তাহলে এন্টিবায়োটিক এবং সহায়ক চিকিৎসায় খুব সহজেই সেরে যায়।”

মজনু মিয়ার চোখ বড় হয়ে গেল। “কিন্তু পীর সাহেব বললেন, এটা দেবীর খেলা, ওষুধে কাজ হয় না।”

রফিক মৃদু হেসে বললেন, “চাচা, রোগ জীবাণুর কারণে হয়, কোনো দেবীর কারণে নয়। আর এসব জীবাণু মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখা যায়। বিজ্ঞান এসব রোগের কারণ এবং প্রতিকার দুটোই খুঁজে বের করেছে।”

মজনু মিয়া চুপ করে রইলেন। তার মনে পড়লো, শামীমের ছটফটানি। যদি তিনি সেদিন পীর সাহেবের বদলে ডাক্তার দেখাতেন, তাহলে কি শামীম বেঁচে যেত? এই চিন্তাটা যেন বিষাক্ত সাপের মতো তার মনকে দংশন করতে লাগল।

রফিক আরও বললেন, “কিছু কুসংস্কার আমাদের সমাজের শেকড়ে গেঁথে আছে, চাচা। এসব কুসংস্কার আমাদের জীবন কেড়ে নেয়। বিশ্বাস ভালো, কিন্তু অন্ধ বিশ্বাস আর কুসংস্কারের পার্থক্য বুঝতে হবে।”


রফিক চলে যাওয়ার পর মজনু মিয়া ঘরে ঢুকলেন। ঘরের কোণে পড়ে থাকা পীর সাহেবের দেওয়া মাদুলিটা তুলে নিলেন। এটা কি তাহলে শুধুই একটা সুতো আর কিছু লতাপাতা? এটাই কি তার ছেলেকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরাতে পারতো না?

তার মনে পড়লো, ছোটবেলায় গ্রামের অনেক মানুষ কলেরায় মারা যেত। তখনো পীর সাহেবরা বলতেন, এটা আল্লাহর গজব। কিন্তু পরে শহরে কলেরার প্রতিষেধক আবিষ্কার হলো, স্যানিটেশন ভালো হলো, আর কলেরায় মৃত্যু কমে গেল। তাহলে কি এসব রোগের পেছনে কোনো ঈশ্বরের রাগ নয়, বরং জীবাণু আর অপরিষ্কার পরিবেশই দায়ী?

মজনু মিয়ার ভেতরে থাকা বিশ্বাসের দেয়ালটা যেন ভাঙতে শুরু করলো। যে বিশ্বাসকে তিনি এতদিন ধরে আঁকড়ে ধরেছিলেন, তা যেন ধুলোয় মিশে যাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারলেন, তার গোঁড়ামি আর কুসংস্কারে অন্ধ বিশ্বাসই তার ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে। শামীম মারা যায়নি দেবীর রোষে বা আল্লাহর গজবে, বরং মারা গেছে তার নিজের অজ্ঞতা আর অন্ধত্বের কারণে।

তিনি আর নামাজ পড়েন না। মসজিদে যান না। গ্রামের মানুষ তাকে নিয়ে যা খুশি বলুক, তার আর কিছু যায় আসে না। তার কাছে এখন সবচেয়ে বড় সত্য হলো বিজ্ঞান। কারণ বিজ্ঞানই তাকে দেখিয়েছিল, কীভাবে তার সন্তানের জীবন বাঁচানো যেত।


একদিন মজনু মিয়াকে দেখা গেল রফিকের ডিসপেন্সারির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে একটা বই, যেটা রফিক তাকে দিয়েছিলেন – সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের কিছু মৌলিক ধারণা। তিনি এখন নিয়মিত রফিকের কাছে আসেন, বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের কথা শোনেন, রোগের কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানতে চান।

গ্রামের মানুষ তখনো তাকে নিয়ে ফিসফিস করে, “মজনু মিয়ার মাথাটা একেবারেই গেছে। ধর্ম-কর্ম ছেড়ে এখন নাকি ডাক্তারবাবুর পা চাটে।”

কিন্তু মজনু মিয়া সেসব শোনেন না। তিনি জানেন, তার জীবন থেকে সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা তিনি সবচেয়ে মূল্যবান কিছুর বিনিময়ে শিখেছেন। তিনি শিখেছেন, অন্ধ বিশ্বাস মানুষকে কতটা অসহায় করে তোলে। তিনি শিখেছেন, যুক্তি, বিজ্ঞান এবং মানবতাই পারে প্রকৃত অর্থে মানুষকে বাঁচাতে, তাকে মুক্তি দিতে।

মজনু মিয়ার মনে তখন আর কোনো দেব-দেবী বা অলৌকিক শক্তির ভয় নেই। আছে কেবল তার মৃত সন্তানের প্রতি গভীর বেদনা এবং বিজ্ঞান ও যুক্তির প্রতি এক নতুন করে জন্ম নেওয়া শ্রদ্ধা। তিনি এখন আর ঈশ্বরের কাছে কিছু চান না। কারণ তিনি বুঝে গেছেন, এই পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে, তা প্রাকৃতিক নিয়মেই ঘটে। আর মানুষের মুক্তি আসে তাদের নিজেদের প্রচেষ্টায়, নিজেদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানের জয়, ঈশ্বরের প্রতি মানুষের বিশ্বাস হারানোর জন্য যুক্তিবাদ এবং বিজ্ঞানের জয়ের ভুমিকা না বললেই নয়। চলুন এই বিষয়টিও একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি:


ঈশ্বরের মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানোর কারণ

যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানের জয়: মানবজাতির আলোকবর্তিকা

পৃথিবীতে আলো আসার আগে যেমন আঁধার ছিল, তেমনি মানুষের জীবনেও একসময় ছিল অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের ঘোর অন্ধকার। সেই সময়ে মানুষ প্রকৃতির রহস্যকে বুঝত না, রোগব্যাধিকে মনে করত দেব-দেবীর অভিশাপ, আর ঝড়-বৃষ্টিকে দেখত অলৌকিক শক্তির প্রকাশ হিসেবে। কিন্তু ধীরে ধীরে, মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করল—কেন? কীভাবে? এই ‘কেন’ আর ‘কীভাবে’-এর উত্তর খুঁজতে গিয়েই জন্ম হলো যুক্তিবাদ (Rationalism) আর বিজ্ঞান (Science)-এর।

যুক্তিবাদ হলো সেই মানসিকতা, যেখানে কোনো কিছুকে মেনে নেওয়ার আগে তার পেছনের কারণ, যুক্তি এবং প্রমাণ খোঁজা হয়। আর বিজ্ঞান হলো সেই পদ্ধতি, যা পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন করে। এই দুটোর হাত ধরেই মানবজাতি অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা শুরু করেছে।


অজ্ঞতার শেকল ভাঙা: বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা

একসময় মানুষ মনে করত, পৃথিবী সমতল এবং মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত। সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। যারা এই ধারণার বিরুদ্ধে কথা বলত, তাদের শাস্তি পেতে হতো। কিন্তু গ্যালিলিও গ্যালিলি এবং নিকোলাস কোপার্নিকাস-এর মতো বিজ্ঞানীরা যুক্তির পথ ধরে প্রমাণ করলেন যে, সূর্যই সৌরজগতের কেন্দ্রে, আর পৃথিবী তার চারপাশে ঘোরে। এই আবিষ্কারগুলো কেবল মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণাই বদলে দেয়নি, বরং মুক্তচিন্তা এবং যুক্তির শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

যখন প্লেগ মহামারিতে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছিল, তখনো অনেকে মনে করত, এটা ঈশ্বরের শাস্তি। কিন্তু লুই পাস্তুর এবং রবার্ট কচ-এর মতো বিজ্ঞানীরা দেখালেন যে, রোগের কারণ অদৃশ্য জীবাণু। তাদের আবিষ্কারের ফলে মানুষ টিকা এবং ওষুধের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধের উপায় পেল। আজ আমরা পোলিও, বসন্ত, হামের মতো রোগ থেকে মুক্ত, যা সম্ভব হয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য উন্নতির কারণে।


প্রযুক্তির আশীর্বাদ: দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের প্রভাব:

যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানের ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি আধুনিক প্রযুক্তি, যা আমাদের জীবনকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে।

  • যোগাযোগ ব্যবস্থা: একসময় চিঠি পৌঁছাতে মাস লেগে যেত, আর এখন স্মার্টফোনের কল্যাণে আমরা মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে থাকা মানুষের সাথে কথা বলতে পারি, ছবি দেখতে পারি, বা ভিডিও কলে যুক্ত হতে পারি। এটা সম্ভব হয়েছে ইন্টারনেট এবং টেলিকমিউনিকেশন বিজ্ঞানের কারণে।
  • পরিবহন: ঘোড়ায় চড়ে বা হেঁটে যে পথ পাড়ি দিতে মাসের পর মাস লাগত, এখন সেই পথ বিমান, ট্রেন বা গাড়িতে করে কয়েক ঘণ্টায় পাড়ি দেওয়া যায়। এটা পদার্থবিজ্ঞান এবং প্রকৌশলবিদ্যার জয়।
  • কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা: একসময় খাদ্যের অভাবে দুর্ভিক্ষ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এখন কৃষিবিজ্ঞান এবং জেনেটিক্স-এর কল্যাণে উন্নত বীজ, সার ও সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা বিপুল পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন করতে পারছি, যা কোটি কোটি মানুষের খাদ্যের সংস্থান করছে।

মানবিকতা ও প্রগতির পথ: যুক্তিবাদী সমাজ

যুক্তিবাদ শুধু বিজ্ঞানকে এগিয়ে নেয় না, এটি একটি মানবিক ও প্রগতিশীল সমাজ গঠনেও সাহায্য করে।

  • সহনশীলতা: যুক্তিবাদ মানুষকে ভিন্নমতকে সম্মান করতে শেখায়। যখন আমরা কোনো কিছুকে যুক্তি দিয়ে বিচার করি, তখন আমরা বুঝতে পারি যে, ভিন্ন দৃষ্টিকোণও থাকতে পারে। এটি ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং জাতিগত বিদ্বেষ কমাতে সাহায্য করে।
  • শিক্ষার প্রসার: যুক্তিবাদী সমাজ শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়। বিজ্ঞান শেখায়, জ্ঞান অর্জন করা জরুরি। এর ফলে মানুষ কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসে এবং নিজেদের জীবনকে আরও ভালোভাবে গড়ে তুলতে পারে।
  • নৈতিকতার ভিত্তি: যুক্তিবাদ মানুষকে শেখায়, নৈতিকতা কোনো ঐশ্বরিক নির্দেশ নয়, বরং মানবজাতির টিকে থাকার জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত। অন্যের ক্ষতি না করা, সহযোগিতা করা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা – এসবই যুক্তিবাদী চিন্তার ফসল।

চ্যালেঞ্জ এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ

অবশ্য, যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানের পথেও চ্যালেঞ্জ আছে। এখনো পৃথিবীর অনেক জায়গায় কুসংস্কার, ভুল তথ্য এবং অন্ধ বিশ্বাস মানুষকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব বা সামাজিক অসমতার মতো সমস্যাগুলো আমাদের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

তবে, আশার কথা হলো, মানুষ এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য আরও বেশি করে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানের ওপর আস্থা রাখছে। বিজ্ঞানীরা দিনরাত কাজ করছেন এসব সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার জন্য। মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসতি স্থাপন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ, বা ক্যান্সারের মতো রোগের নিরাময় – এসবই আমাদের ভবিষ্যৎকে আরও উজ্জ্বল করে তুলছে।

আমরা যখন অতীতের দিকে তাকাই, তখন দেখতে পাই, মানুষ কতটা পথ পেরিয়ে এসেছে। এই পথচলার প্রতিটি ধাপে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানই ছিল আমাদের আলোকবর্তিকা। তারা শুধু আমাদের জীবনকে সহজ করেনি, বরং আমাদের চিন্তাভাবনাকে প্রসারিত করেছে, নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে, এবং মানবজাতিকে একটি উন্নত ও সভ্য সমাজের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

এই যাত্রা কখনো থামবে না। যতক্ষণ মানুষ প্রশ্ন করবে, যুক্তি খুঁজবে, আর জ্ঞান অন্বেষণ করবে, ততক্ষণ যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞান জয়ী হবে। আর এই জয় আমাদের সবার, পুরো মানবজাতির জয়।

আলোর রেখা: একটি গ্রামের জেগে ওঠার গল্প

মোহাম্মদ বাইতুল্লাহ

গফুর মিয়া তখন ছোট। তাদের গ্রামটা ছিল কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের আঁধারে ঢাকা। একটু জ্বর-সর্দি হলে লোকে ডাক্তারের কাছে যেত না, যেত কবিরাজ বা ওঝার কাছে। ফসল নষ্ট হলে বলা হতো, ‘আল্লাহর গজব’, আর গ্রামের পুকুরে মাছ মরে ভেসে উঠলে মনে করা হতো, ‘ভূতের কাজ’। গফুরের দাদীমা বলতেন, “রাতবিরেতে গাছের দিকে তাকাবি না, জিন থাকে।” গফুর ভয়ে কুঁকড়ে যেত।

একদিন গ্রামের মফিজ মিয়ার ছোট ছেলেটার টাইফয়েড জ্বর হলো। দিন দিন ছেলেটা শুকিয়ে যাচ্ছিল। গ্রামের কবিরাজ গলা ফুলিয়ে বললেন, “এটা বাতাস লাগা রোগ, জিন পরীর আছর পড়েছে। লতাপাতা বেঁধে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।” মফিজ মিয়া বিশ্বাস করে তাই করলেন। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই ছেলেটা মারা গেল। গফুর দেখেছিল, মফিজ মিয়া আর তার স্ত্রী আহাজারি করছিলেন। গফুরের মনে একটা প্রশ্ন খচখচ করে উঠল, “যদি আল্লাহর ইচ্ছা হয়, তাহলে কবিরাজ কী করে? আর যদি জিন পরীর আছর হয়, তাহলে তাদের কেন এত কষ্ট?” কিন্তু এই প্রশ্ন করার মতো সাহস তার ছিল না।


গফুর বড় হতে লাগল। সে দেখল, গ্রামের মানুষের জীবন যেন একই বৃত্তে ঘুরছে। দারিদ্র্য, রোগ আর অশিক্ষায় ভুগছে সবাই। গ্রামে স্কুল থাকলেও বেশিরভাগ ছেলেমেয়েদের বাবা-মা ভাবত, ‘পড়ালেখা করে কী হবে? আল্লার রহমত থাকলে এমনিতেই ভালো হবে।’

গফুর যখন হাইস্কুলে ভর্তি হলো, তখন তার পরিচয় হলো নতুন আসা এক শিক্ষকের সাথে। নাম তার সজল স্যার। সজল স্যার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা এক তরুণ। তিনি শুধু বইয়ের পড়া শেখাতেন না, তিনি শেখাতেন প্রশ্ন করতে, যুক্তি দিয়ে ভাবতে। তিনি ক্লাসে বলতেন, “সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে কেন? বৃষ্টি কেন হয়? আমাদের শরীর কিভাবে কাজ করে? এসবের পেছনে কোনো যাদু নেই, আছে বিজ্ঞান।”

একদিন সজল স্যার তাদের গ্রামের পুকুরে মাছ মরে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করলেন। “পুকুরে অক্সিজেনের অভাব হলে, অথবা দূষণ হলে মাছ মারা যায়। এটা কোনো ভূতের কাজ নয়।” তিনি বুঝিয়ে বললেন, কিভাবে পুকুরে অক্সিজেন বাড়ানো যায়, বা কিভাবে দূষণ কমানো যায়। গ্রামের কিছু যুবক সজল স্যারের কথা শুনে পুকুর পরিষ্কারের উদ্যোগ নিল। ধীরে ধীরে পুকুরের মাছ মরা কমে গেল। গ্রামের মানুষ অবাক হলো।

সজল স্যার গ্রামের মানুষের মধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব বোঝাতে লাগলেন। তিনি বললেন, “হাত না ধুয়ে খেলে পেটে রোগ হয়। বিশুদ্ধ পানি না পান করলে কলেরা হয়।” অনেকে প্রথমদিকে হাসাহাসি করল, “এগুলো আবার কেমন কথা?” কিন্তু যখন সজল স্যারের কথা মেনে গ্রামের কিছু পরিবার পরিচ্ছন্নতা মেনে চলতে শুরু করল এবং তাদের ছেলেমেয়েরা সুস্থ থাকতে লাগল, তখন অন্যরা একটু একটু করে আগ্রহী হলো।


সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটা এল যখন গ্রামে এক ভয়াবহ কলেরা মহামারি দেখা দিল। একে একে মানুষ মরতে লাগল। গ্রামের কবিরাজরা হাত তুলে দিল, “এটা আল্লাহর গজব! একমাত্র দোয়া আর মানত ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

কিন্তু সজল স্যার হাল ছাড়লেন না। তিনি শহরে ফোন করে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি দল আনলেন। ডাক্তাররা গ্রামের মানুষকে বিশুদ্ধ পানি পান করতে শেখালেন, ওরস্যালাইন বানানোর পদ্ধতি শেখালেন, আর যারা বেশি অসুস্থ ছিল, তাদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। গফুর তখন সজল স্যারের সাথে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছিল। সে দেখল, কিভাবে মানুষগুলো ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিল।

এক বৃদ্ধা মহিলা, যার স্বামী কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পথে, তিনি কিছুতেই ডাক্তারদের ওষুধ নিতে রাজি হচ্ছিলেন না। তিনি কেবল পীর সাহেবের দেওয়া তাবিজ বুকে নিয়ে বসে ছিলেন। সজল স্যার তাকে বোঝালেন, “মা, এই তাবিজ আপনাকে বাঁচাবে না। এই ডাক্তাররাই আপনাকে বাঁচাতে পারে।” অনেক যুক্তিতর্ক আর অনুরোধের পর মহিলা রাজি হলেন। ডাক্তাররা চিকিৎসা শুরু করলেন। কয়েক দিন পর তার স্বামী সুস্থ হয়ে উঠলেন।

সেই দিন গফুরের মনে হলো, বিজ্ঞানই আসল জাদু। দোয়া বা তাবিজ নয়, মানুষকে বাঁচায় বিজ্ঞান।


কলেরা মহামারির পর গ্রামের মানুষের চোখে যেন নতুন আলো ফুটল। তারা বুঝতে পারল, যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞান কতটা শক্তিশালী হতে পারে। মজনু মিয়ার মতো গোঁড়া মানুষও এখন সজল স্যারের কথা শোনেন। তিনি এখন আর রোগ হলে কবিরাজের কাছে যান না, সরাসরি ডাক্তারের কাছে যান।

গফুর নিজে ডাক্তারি পড়ার জন্য শহরে চলে গেল। সে মনে মনে পণ করেছিল, একদিন সেও গ্রামের মানুষের জন্য সজল স্যারের মতো কাজ করবে। সে বিজ্ঞান আর যুক্তির আলো ছড়িয়ে দেবে।

বছর দশেক পর গফুর যখন গ্রামে ফিরে এল, তখন সে একজন সফল ডাক্তার। গ্রামের চেহারাটাই বদলে গেছে। এখন গ্রামে একটি ছোট হাসপাতাল আছে, যেখানে আধুনিক চিকিৎসা হয়। কৃষকরা এখন উন্নত বীজ ব্যবহার করে, রাসায়নিক সার ব্যবহার করে, আর আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে ফসল ফলায়। আগে যেখানে বিদ্যুতের অভাবে রাত হলে গ্রামটা আঁধারে ডুবে যেত, এখন সেখানে সোলার প্যানেলের কল্যাণে রাতেও আলো জ্বলে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়, এমনকি মেয়েরাও এখন পড়াশোনা করে।


একদিন গফুর তার বাবা-মার সাথে রাতের খাবার খাচ্ছিল। মা বললেন, “গফুর, আমাদের গ্রামে যে এত পরিবর্তন এল, এর পেছনে সজল স্যার আর তোর মতো শিক্ষিত মানুষদের অবদান অনেক।”

গফুর হাসল। “মা, এটা কোনো একজনের অবদান নয়। এটা হলো যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানের জয়। যখন মানুষ অন্ধবিশ্বাস ছেড়ে যুক্তি দিয়ে ভাবতে শুরু করে, তখনই তারা নতুন পথ দেখতে পায়। যখন তারা প্রকৃতির রহস্যকে বিজ্ঞান দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, তখনই তারা সেই রহস্যকে নিজেদের কাজে লাগাতে পারে।”

সে বলল, “আগে আমরা ভাবতাম, আমাদের ভাগ্য ঈশ্বর বা অদৃশ্য শক্তি দ্বারা নির্ধারিত। কিন্তু এখন আমরা বুঝতে পারছি, মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্য গড়ে তুলতে পারে। যখন আমরা আমাদের মেধা আর জ্ঞানকে ব্যবহার করি, তখন আমরা অনেক অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারি।”

আজ গফুর মিয়া তার গ্রামের দিকে তাকিয়ে দেখে। একসময় যে গ্রামটা ছিল কুসংস্কারের আঁধারে ঢাকা, আজ তা আলোকিত এক জনপদ। এই আলো এসেছে বিজ্ঞান আর যুক্তির পথ ধরে। মানুষ এখন আর ভয়ে কুঁকড়ে থাকে না, তারা প্রশ্ন করে, শেখে, আর এগিয়ে যায়। আর গফুর জানে, এই পথচলায় তারাই প্রকৃত বিজয়ী, যারা জ্ঞান আর প্রজ্ঞাকে নিজেদের জীবনের চালিকাশক্তি বানিয়েছে।

চলুন আমরা এউ বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি:


মানুষ: নিজের কর্মের কারিগর, অলৌকিকতার নয়

মানুষের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, একসময় অধিকাংশ মানুষই নিজেদের জীবনকে কোনো না কোনো অলৌকিক শক্তির হাতে সঁপে দিতো। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ-শোক, এমনকি ফসলের ভালো-মন্দ সবকিছুকেই তারা এক অদৃশ্য শক্তির ইচ্ছা বলে মনে করত। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছে যে, তাদের ভাগ্য কোনো অলৌকিক শক্তির ছায়া নয়, বরং তাদের নিজের কর্ম, প্রচেষ্টা আর সিদ্ধান্তের ফসল


কর্মের শক্তি: নিজের ভাগ্য গড়া

মানুষের জীবনে ভালো-মন্দ যাই ঘটুক না কেন, তার পেছনে তাদের নিজস্ব কর্মের অবদান অনস্বীকার্য।

  • শিক্ষায় উন্নতি: একজন শিক্ষার্থী যদি পড়াশোনা না করে শুধু ঈশ্বরের কাছে ভালো ফলের জন্য প্রার্থনা করে, তাহলে সে কখনো সফল হবে না। তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, নিয়মিত ক্লাস করতে হবে, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে হবে। তার এই পরিশ্রমই তাকে ভালো ফল এনে দেবে, কোনো অলৌকিক শক্তি নয়।
  • স্বাস্থ্য রক্ষা: রোগ হলে ডাক্তার না দেখিয়ে শুধু দোয়া বা তাবিজের ওপর ভরসা করলে রোগ সারবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন – এই কর্মগুলোই মানুষকে সুস্থ রাখে।
  • অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি: কেউ যদি দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে চায়, তাকে কাজ করতে হবে, দক্ষতা বাড়াতে হবে এবং সঠিক পরিকল্পনা নিতে হবে। অলস বসে থেকে ভাগ্যের দোহাই দিলে তার অবস্থার পরিবর্তন হবে না। নিজের প্রচেষ্টা এবং উদ্ভাবনী শক্তিই তাকে সমৃদ্ধি এনে দিতে পারে।

মানুষের এই বিশ্বাস যে, তারা নিজের কর্মের মাধ্যমে তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তা তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং দায়িত্ববোধ তৈরি করে। যখন একজন ব্যক্তি জানে যে তার সাফল্য বা ব্যর্থতা তার নিজের হাতে, তখন সে আরও বেশি সতর্ক হয়, আরও বেশি পরিশ্রম করে এবং তার সিদ্ধান্তের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে।


অলৌকিকতার সীমাবদ্ধতা: কেন মানুষ এটি থেকে দূরে সরছে

অলৌকিক শক্তির ওপর অন্ধ বিশ্বাস মানুষকে অনেক সময় নিষ্ক্রিয় করে তোলে। যখন মানুষ মনে করে যে সব কিছু ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হচ্ছে, তখন তারা নিজেদের অবস্থার উন্নতি করার জন্য চেষ্টা করা বন্ধ করে দেয়

  • আশাবাদী নিষ্ক্রিয়তা: অনেকে বিশ্বাস করে, যা হওয়ার তা হবেই, এর পেছনে কোনো মানুষের হাত নেই। এই ধরনের চিন্তা তাদের মধ্যে আশাবাদী নিষ্ক্রিয়তা তৈরি করে, যা তাদের ব্যক্তিগত বা সামাজিক অগ্রগতিতে বাধা দেয়।
  • কুসংস্কারের বিস্তার: অলৌকিকতার ওপর বিশ্বাস প্রায়শই কুসংস্কারের জন্ম দেয়। রোগ হলে ডাক্তার না দেখিয়ে ওঝার কাছে যাওয়া, খারাপ কিছু ঘটলে ‘জিন-ভূতের আছর’ বলে মনে করা—এগুলো সবই অলৌকিকতার ওপর অন্ধ বিশ্বাসের ফল, যা মানুষকে ক্ষতিগ্রস্থ করে।
  • শোষণ: অলৌকিকতার দোহাই দিয়ে একশ্রেণির মানুষ সরল-সহজ মানুষকে শোষণ করে। তারা অলৌকিক ক্ষমতার ভুয়া দাবি করে অর্থ আদায় করে বা মানুষকে ভুল পথে চালিত করে।

বিজ্ঞানের শক্তি: যুক্তির মাধ্যমে জীবন নিয়ন্ত্রণ

আধুনিক যুগে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ মানুষকে অলৌকিকতার বেড়াজাল থেকে মুক্তি দিয়েছে। বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, এই মহাবিশ্ব প্রাকৃতিক নিয়মেই চলে।

  • রোগ নিরাময়: আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান জীবাণু, ভাইরাস এবং শরীরের জৈবিক প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করে রোগ নিরাময়ের পথ দেখায়। এখানে কোনো অলৌকিক শক্তির হাত নেই, আছে পর্যবেক্ষণ, গবেষণা এবং ওষুধের কার্যকারিতা
  • প্রাকৃতিক দুর্যোগ: আবহাওয়ার পূর্বাভাস, ভূমিকম্পের কারণ বিশ্লেষণ – এসবই বিজ্ঞান সম্ভব করেছে। মানুষ এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য অলৌকিক শক্তিকে দায়ী না করে, বৈজ্ঞানিক উপায়ে এর মোকাবিলা করার চেষ্টা করে।
  • প্রযুক্তিগত অগ্রগতি: মহাকাশ গবেষণা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রযুক্তির ব্যবহার – সবই মানুষের মেধা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফল। এগুলোর পেছনে কোনো অলৌকিক হস্তক্ষেপ নেই।

মানুষ যখন বুঝতে পারে যে, তারা তাদের পরিবেশকে পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তখন তারা আরও আত্মবিশ্বাসী হয় এবং নিজের সক্ষমতার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে।


মানবতা ও প্রগতির পথ: নিজেদের ওপর বিশ্বাস

মানুষ যখন নিজের কর্মের ওপর বিশ্বাস রেখে জীবনযাপন করে, তখন তার মধ্যে দায়িত্ববোধ এবং মানবতাবোধ জন্ম নেয়।

  • সামাজিক উন্নয়ন: তারা বোঝে যে, একটি সুন্দর সমাজ গড়তে হলে প্রতিটি ব্যক্তিকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। রাস্তা পরিষ্কার রাখা, নিয়ম মেনে চলা, অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া—এগুলো সবই মানুষের ব্যক্তিগত কর্মের সমষ্টি
  • নৈতিকতা: মানুষের নৈতিকতা কোনো অলৌকিক নির্দেশ থেকে আসে না, বরং সমাজের ভালো থাকার জন্য এটি একটি অপরিহার্য শর্ত। চুরি না করা, মিথ্যা না বলা, অন্যের ক্ষতি না করা – এগুলো মানুষের নিজেদের তৈরি করা মূল্যবোধ, যা তাদের সুষ্ঠু জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য।

মূলত, মানুষ এখন বুঝতে পেরেছে যে, তাদের ভাগ্য তাদেরই হাতে। তারা তাদের জ্ঞান, বুদ্ধি, কর্ম এবং প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজেদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অলৌকিকতার ওপর নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে তারা নিজেদের সক্ষমতার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করছে, আর এই বিশ্বাসই তাদের প্রগতি এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এটি কেবল একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাস নয়, বরং একটি সামাজিক এবং মানবিক পরিবর্তন, যা মানবজাতিকে আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে চালিত করছে।

এই বিষয়টি আরও ভালোভাবে বুঝার জন্য আমরা শেষ আরও একটি গল্প তুলে ধরতে পারি, তবে চলুন শুরু করি!


নিয়তির হাতের মুঠোয় নয়, নিজের হাতের তালুতে: সাগরডীঘির জাগরণ

মোহাম্মদ বাইতুল্লাহ

সাগরডীঘি নামটা শুনলে মনে হতো যেন গ্রামের পাশ দিয়ে বুঝি বিশাল এক সাগর বয়ে গেছে। আসলে তা নয়, গ্রামের ঠিক মাঝখানে ছিল এক মাঝারি আকারের পুকুর, নাম তার সাগরডীঘি। এই পুকুরটাই ছিল গ্রামের প্রাণ। এর পানি দিয়ে চাষ হতো, মহিলারা কাপড় কাচত, গোসল সারত। গ্রামের মানুষগুলো ছিল সাদাসিধে, মাটির মানুষ। তবে তাদের জীবনের প্রতিটি বাঁকে ছিল এক অদৃশ্য শক্তির ছায়া। ‘নসিব’, ‘ভাগ্য’, ‘আল্লাহর ইচ্ছা’—এই শব্দগুলো যেন তাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে মিশে ছিল। যা হওয়ার, তা হবেই। মানুষের হাতে কিছু নেই। এই ছিল তাদের মূলমন্ত্র।


আজগর আলি ছিলেন গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ। তার সাদা দাড়ি আর ঋজু দেহটা দূর থেকে দেখলে মনে হতো যেন কোনো ঋষি। তার মুখে সবসময় লেগে থাকত একই বুলি, “আল্লার যা ইচ্ছা, তাই হয়। মানুষের হাত নেই।” তিনি পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমিতে চাষাবাদ করতেন। কিন্তু তার খেতগুলো দেখলে বোঝা যেত, শুধু ‘ইচ্ছা’র ওপর ভরসা করে চাষ করলে কী হয়। আগাছায় ভরা, মাটি ফেটে চৌচির। ফসল তেমন ফলত না। যখন ফসল মার খেত, আজগর আলি শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, “নসিব! আল্লা আমাদের এইটুকুই দিতে চেয়েছেন।” তার একমাত্র ছেলে রফিক, বাবার এই দার্শনিক আলোচনা শুনে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যেত। রফিকের মনে প্রশ্ন জাগত, রহমত চাচার খেতটা সবসময় শস্যে ভরা থাকে কেন? রহমত চাচা তো দিনরাত খেটে মরত, নতুন নতুন সার ব্যবহার করত, সেচ দিত। রফিক বাবাকে বলত, “বাবা, রহমত চাচা তো নসিবের কথা বলে বসে থাকে না। সে পরিশ্রম করে বলেই তার ফসল ভালো হয়।” আজগর আলি একগাল হেসে বলতেন, “ওর নসিবে আছে, তাই পায়। আমাদের নসিবে নেই।”


রফিকের ছেলেবেলা থেকেই এই ‘নসিব’ শব্দটার প্রতি একটা বিতৃষ্ণা ছিল। সে দেখত, তার বন্ধুরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে মাঠে ঘুরে বেড়াত, আর বলত, ‘লেখাপড়া করে কী হবে? কপালে চাকরি থাকলে এমনিতেই হবে।’ রফিক কিন্তু চুপিসারে পড়াশোনা করত। সে জানত, নিজের চেষ্টাই একমাত্র পথ।

এক বছর। সেই বছরটা ছিল সাগরডীঘি গ্রামের জন্য এক অভিশাপ। হঠাৎ করে এক অজানা রোগ ছড়িয়ে পড়ল। জ্বর, কাশি আর শ্বাসকষ্ট। গ্রামের আকাশে-বাতাসে যেন মৃত্যুর হাতছানি। একে একে মানুষ অসুস্থ হতে শুরু করল। গ্রামের ওঝা-কবিরাজরা জড়ো হলো। তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ ওঝা, হাতে একটা বাঁশের লাঠি ঠুকে ঠুকে বললেন, “এটা শনির দশা! মন্দ আত্মার আছর পড়েছে! পীর সাহেবের দরগায় সিন্নি দিতে হবে। আরও বেশি করে দোয়া-দরুদ পড়তে হবে।” গ্রামের সরল মানুষ তাই করল। টাকা দিয়ে সিন্নি দিল, পীর সাহেবের দেওয়া জলপড়া নিল, ঘরের চারপাশে তাবিজ বাঁধল। কিন্তু রোগ কমলো না, বরং বাড়ল। প্রতিদিন সকালে সূর্য ওঠার আগে শোনা যেত কান্নার রোল। কত মানুষ মারা গেল! আজগর আলির ছোট নাতনিটা, রফিকের একমাত্র মেয়ে, আট বছরের রুম্পা, অসুস্থ হয়ে পড়ল। তার ছোট ছোট নিঃশ্বাসগুলো যেন বাতাসের সাথে যুদ্ধ করছিল।

রফিকের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে দেখল, আজগর আলিও রুম্পার জন্য সিন্নি দিতে গেলেন। ফিরে এসে চোখ বন্ধ করে বললেন, “আল্লা চাইলে সুস্থ হবে। আমাদের চেষ্টা তো শেষ।”

রফিক আর চুপ থাকতে পারল না। তার ভেতরে এতদিন ধরে জমা ক্ষোভটা যেন বিস্ফোরিত হলো। সে চিৎকার করে উঠল, “না বাবা, এটা আল্লার ইচ্ছা নয়! এটা আমাদের অজ্ঞতা! আমরা এই রোগটার সঠিক চিকিৎসা করছি না বলেই মানুষ মরছে!”

আজগর আলি অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার চোখে অবিশ্বাস। “তাহলে কী করবি? অলৌকিক শক্তিকে বিশ্বাস করবি না?”

“আমি নিজের পরিশ্রমকে বিশ্বাস করি, নিজের বুদ্ধিকে বিশ্বাস করি!” রফিক বলল। তার চোখে আগুন জ্বলছিল। “আমি ডাক্তার আনব! শহরের ডাক্তার!”

কিন্তু ডাক্তার আনা মুখের কথা ছিল না। গ্রামে কোনো পাকা রাস্তা ছিল না। বর্ষার কাদা আর দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে শহর থেকে ডাক্তার আসতে চাইতেন না। রফিক কিন্তু দমে গেল না। সে গ্রামের কিছু যুবককে নিয়ে চাঁদা তুলল। তারপর সে নিজেই রিকশাভ্যান নিয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে শহরের হাসপাতালে গেল। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর এক তরুণ ডাক্তার, নাম তার আবির, গ্রামে আসতে রাজি হলেন। আবির আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশ্বাসী এক যুবক।


ডাক্তার আবির গ্রামে এসে সব দেখে আঁতকে উঠলেন। তিনি বললেন, “চাচা, এটা কোনো শনির দশা নয়, ভাইরাসজনিত ইনফেকশন। সর্দি-কাশি আর জ্বরের সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এর জন্য দায়ী হলো জীবাণু, যা খালি চোখে দেখা যায় না। কিন্তু পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখলে, বিশুদ্ধ পানি পান করলে আর সঠিক ওষুধ ব্যবহার করলে এই রোগ সারানো সম্ভব।” তিনি সঙ্গে করে কিছু ওষুধ এনেছিলেন। তিনি গ্রামের মানুষকে বিশুদ্ধ পানি পান করতে শেখালেন, ওরস্যালাইন বানানোর পদ্ধতি শেখালেন, আর যারা বেশি অসুস্থ ছিল, তাদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন।

সজল স্যার, যিনি পাশের গ্রামের স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, তিনি তখনো গ্রামে অবস্থান করছিলেন। তিনি এসে ডাক্তার আবিরকে সাহায্য করলেন। তিনি মানুষকে সহজ ভাষায় বোঝালেন, “ভাইরাস মানে কী। কিভাবে এটা একজনের থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়ায়। হাত না ধুয়ে খেলে কেন রোগ হয়।”

রফিক, সজল স্যার আর ডাক্তার আবিরের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষ সুস্থ হতে শুরু করল। আজগর আলি নিজের চোখে দেখলেন, তার নাতনি রুম্পা সুস্থ হয়ে উঠেছে। কোনো সিন্নিতে নয়, কোনো পীর সাহেবের দোয়াতে নয়, রুম্পা সুস্থ হয়েছে ডাক্তার আবিরের ওষুধে, সজল স্যারের জ্ঞানে আর রফিকের পরিশ্রমে।

সেই দিনের পর থেকে সাগরডীঘি গ্রামের মানুষের জীবনে এক নীরব বিপ্লব এল। আজগর আলি আর আগের মতো ‘নসিবের দোহাই’ দেন না। তিনি এখন নিয়মিত তার খেত পরিষ্কার করেন, নতুন উন্নত সার ব্যবহার করেন। রফিককে জিজ্ঞেস করেন, “বাবা, এই সারের পেছনে বিজ্ঞানটা কী?” তার খেত এখন শস্যে ভরা থাকে।


গ্রামের মহিলারা এখন পুকুরে কাপড় কাচার পর নিজেদের ঘর পরিষ্কার রাখে, বাচ্চাদের হাত ধুতে শেখায়, ফোটানো পানি পান করায়। কেউ অসুস্থ হলে প্রথমে ডাক্তারের কাছে যায়। গ্রামের যুবক-যুবতীরা এখন পড়াশোনা করে, শহরের দিকে যায় নতুন জ্ঞান আর দক্ষতা অর্জন করতে। আগে যেখানে বিদ্যুতের অভাবে রাত হলে গ্রামটা আঁধারে ডুবে যেত, এখন সেখানে সোলার প্যানেলের কল্যাণে রাতেও আলো জ্বলে। গ্রামটা যেন আধুনিকতার ছোঁয়ায় জেগে উঠেছে।

একদিন গ্রামে একটি বড় মিটিং হচ্ছিল। রফিক, সজল স্যার আর স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিলেন। চেয়ারম্যান বললেন, “আমাদের গ্রামটা আজ এত উন্নত হয়েছে, রোগমুক্ত হয়েছে, এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান হলো, আমরা নিজের ওপর বিশ্বাস রেখেছি। কোনো অলৌকিক শক্তির ওপর ভরসা করে বসে থাকিনি।”

রফিকের বাবা আজগর আলি সেই মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। তার মুখে এক পরিতৃপ্তির হাসি। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি সারাজীবন নসিবের কথা বলে কাটিয়েছি। আমি ভুল ছিলাম। আমার ছেলেটা আমাকে শিখিয়েছে, নসিব বলে কিছু নেই। আমাদের কর্মই আমাদের নসিব।”

গ্রামের মানুষ হাততালি দিল। আজগর আলির এই কথা শুনে রফিকের চোখ জলে ভরে উঠল। সে দেখল, গ্রামের প্রতিটা মানুষ যেন এক নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছে। তারা এখন জানে, তাদের ভবিষ্যৎ কোনো অলৌকিক শক্তির হাতে নয়, বরং তাদের নিজেদের হাতের তালুতে। তারা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য গড়ে তুলতে পারে, নিজেদের পরিশ্রম, বুদ্ধি আর জ্ঞান দিয়ে

সাগরডীঘি গ্রামের মানুষ এখন আর ‘নসিবের দোহাই’ দেয় না। তারা এখন বলে, “যদি চেষ্টা করি, যদি পরিশ্রম করি, যদি জ্ঞান অর্জন করি, তাহলে সব হবে। আমাদের নিজেদের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে।” আর এই বিশ্বাসই তাদের জীবনে নিয়ে এসেছে এক নতুন আলোর রেখা, যা তাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে। এই আলোর পথেই যেন তারা খুঁজে পেয়েছে প্রকৃত স্বাধীনতা।

আমার কিছু কথা:

ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারানোর আরও বহু কারণ থাকতে পারে, তবে, আমি যে আলোচনা গুলো করলাম এগুলো সামান্য উদাহরণ মাত্র, ঈশ্বর এমন একটি বিষয় যা কেবল গড়ে উঠেছে মানুষের বিশ্বাস এবং চিন্তা ভাবনায়, সুতরাং এর বাস্তব কোন প্রমাণ বা একান্ত সত্যি বলে মেনে নেওয়ার কোন উপায় নেই। এবং সর্বোপরি আমরা বলতে পারি যে ঈশ্বরের প্রতি মানুষের বিশ্বাস হারানোর সবচেয়ে বড় কারণ এটাই।


এ বিষয়ে আরও ভালো জানতে চাইলে আপনি পড়তে পারেন : কুসংস্কার

আপনি চাইলে আমার এই ব্লগটিও পড়তে পারেন: ইসলামে দাস প্রথা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *