কাজী নজরুল ইসলাম-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী: বিদ্রোহী কবির জীবন
লেখক: মোহাম্মদ বাইতুল্লাহ | প্রকাশক: Dhakapost.net
🔹 পরিচিতি
বাংলা সাহিত্যের আকাশে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি শুধু কবি নন, ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, সাংবাদিক এবং সৈনিক। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তার কলম ছিল এক অজেয় অস্ত্র। “বিদ্রোহী কবি” নামে খ্যাত এই মহান মানুষটি বাঙালির জাতীয় জীবনে অবিস্মরণীয় একটি নাম। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভা।
🔹 শৈশব ও পরিবার
কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালের ২৪ মে, পশ্চিমবঙ্গের (তৎকালীন বঙ্গ) বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন। পরিবারটি ছিল দরিদ্র, কিন্তু ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন নজরুল। ছোটবেলা থেকেই তিনি মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ করতেন এবং ইসলাম ধর্মভিত্তিক গান ও কবিতা লেখার দিকে ঝুঁকে পড়েন।
🔹 শিক্ষাজীবন
নজরুলের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন ছিল অসাধারণ বৈচিত্র্যময়। প্রথমে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা শুরু করেন, এরপর লেটোর দলে (একধরনের লোকগান গাওয়া দল) কাজ করতে করতে সাহিত্যের প্রতি তাঁর ঝোঁক বাড়ে। পরে তিনি আসানসোলের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যান। অতঃপর ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
🔹 সেনাবাহিনীতে কর্মজীবন
১৯১৭ সালে নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি ৪৯তম বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন এবং মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে যে সৈন্য পাঠানো হয়, তার অংশ হিসেবে কাজ করতেন। সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায়ও তিনি কবিতা ও গল্প লেখা অব্যাহত রাখেন। এই সময় তার ‘বাউন্ডুলে’, ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ প্রভৃতি বিখ্যাত কবিতাগুলো লেখা হয়।
🔹 সাহিত্যজীবনের সূচনা
সেনা জীবন শেষে নজরুল ইসলাম কলকাতায় ফিরে আসেন এবং সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা “বিদ্রোহী” প্রকাশিত হয় এবং তিনি রাতারাতি খ্যাতি অর্জন করেন। এই কবিতায় তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ধ্বনিত করেন তীব্র প্রতিবাদ। “আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকেছি পদচিহ্ন!” — এই ধরণের সাহসী ভাষা নজরুলকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।
🔹 সাহিত্যকর্ম
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে এক বৈচিত্র্যপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাঁর লেখালেখির প্রধান শাখাগুলি নিম্নরূপ:
📖 কবিতা:
- বিদ্রোহী (১৯২২)
- আগমনী
- কামাল পাশা
- মুক্তি
- ভাঙার গান
📚 উপন্যাস:
- বাঁধন হারা
- মৃত্যুক্ষুধা
- কুহেলিকা
🎭 নাটক:
- ঝিলিমিলি
- আলী ইবনে আবী তালিব
🎶 গান:
তিনি প্রায় ৪০০০-এর বেশি গান রচনা করেছেন, যেগুলো “নজরুলগীতি” নামে পরিচিত। এই গানগুলোতে ইসলামী ভাব, প্রেম, বিপ্লব, মানবতা এবং প্রকৃতির চিত্র ফুটে ওঠে।
🔹 সাংবাদিকতা ও রাজনীতি
নজরুল ছিলেন প্রতিবাদী সাংবাদিক। তিনি ধূমকেতু, নবযুগ ও লাঙল পত্রিকার সাথে জড়িত ছিলেন। তাঁর সম্পাদকীয় লেখায় ব্রিটিশ শাসনের কড়া সমালোচনা থাকত, যার জন্য তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার হন। “ধূমকেতু” পত্রিকার এক সংখ্যায় “আনন্দময়ীর আগমনে” কবিতা প্রকাশ করায় তিনি ১৯২৩ সালে গ্রেপ্তার হন।
🔹 ধর্মীয় উদারতা ও মানবতা
নজরুল ইসলাম হিন্দু-মুসলমান সকল ধর্মের মানুষকে সমানভাবে ভালোবাসতেন। তিনি অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতার জয়গান গেয়েছেন। ইসলামী সংগীতের পাশাপাশি শ্যামাসংগীত, কীর্তন ইত্যাদিও লিখেছেন, যা নজরুলের অসীম ধর্মীয় সহনশীলতার প্রমাণ।
🔹 ব্যক্তিগত জীবন
১৯২৪ সালে কাজী নজরুল ইসলাম প্রমীলা দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের চার সন্তান ছিল, তবে অধিকাংশই অল্প বয়সে মারা যায়। নজরুলের জীবনজুড়ে ছিল দুঃখ-দুর্দশার ছায়া। স্ত্রী প্রমীলা একসময় পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন, এবং নজরুল নিজেও জীবনের শেষদিকে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হন।
🔹 অসুস্থতা ও নির্বাক জীবন
১৯৪২ সালে নজরুল এক রহস্যজনক অসুস্থতায় আক্রান্ত হন এবং তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। এরপর দীর্ঘ ৩৪ বছর তিনি নির্বাক জীবন কাটান। তাঁর এই অসুস্থতাকে পিক্স ডিজিজ (Pick’s Disease) বলা হয়, যা একটি স্নায়ুবিক ব্যাধি।
🔹 বাংলাদেশে আগমন
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা প্রদান করা হয়। সরকার তাঁর চিকিৎসা ও বাসস্থানের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
🔹 মৃত্যু
১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট (১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকার পিজি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।
🔹 উত্তরাধিকার ও প্রভাব
নজরুল ইসলাম শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, সমগ্র বাঙালির সংস্কৃতিতে এক বিপ্লবী পরিবর্তন এনেছেন। তাঁর গান, কবিতা ও চিন্তাধারা আজও গণসংগীত ও জাতীয় চেতনার অনন্য অনুষঙ্গ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অনেক লেখকই তাঁর দ্বারা প্রভাবিত।
🔹 নজরুল স্মৃতি ও সম্মাননা
- বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি
- নজরুল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা
- নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় (ত্রিশাল, ময়মনসিংহ)
- কবির নামে অসংখ্য সড়ক, প্রতিষ্ঠান, মিলনায়তন
🔹 নজরুলের সাহিত্য দর্শন ও ভাবধারা
কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যের মূল উপজীব্য ছিল বিপ্লব, মানবতা, প্রেম, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, নারী অধিকার এবং সাম্যবাদ। তিনি সমাজের অবিচার, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তার কবিতায় যেমন থাকে বিদ্রোহের আগুন, তেমনি প্রেমিকের কোমলতা ও আত্মিক আরাধনার ধ্যান।
✍️ সাম্য ও মানবতা:
নজরুল বিশ্বাস করতেন সব ধর্ম, জাতি ও মানুষের মধ্যে কোনো বিভেদ থাকা উচিত নয়। তাঁর বিখ্যাত কবিতার পংক্তি—
“মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!”
✍️ নারী অধিকার:
নারীর প্রতি সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও নজরুল ছিলেন সাহসী। “নারী” কবিতায় তিনি বলেন—
“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর!”
✍️ ধর্মীয় ভাবধারা:
নজরুল একাধারে ইসলামী ও হিন্দু ধর্মের ভাবধারায় সাহিত্য রচনা করেছেন। তিনি একদিকে লিখেছেন ইসলামী সংগীত, হামদ, নাত, আবার অন্যদিকে শ্যামাসংগীত, কীর্তন, ভক্তিগীতি। এই বহুমাত্রিকতা নজরুলকে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক বানিয়েছে।
🔹 নজরুল সংগীতের বৈশিষ্ট্য
নজরুল সংগীত বাংলা গানের জগতে একটি পৃথক ধারার সূচনা করেছে। তাঁর সৃষ্ট গানগুলো চারটি বড় শ্রেণিতে ভাগ করা যায়:
- বিপ্লবী গান – যেমন: চল্ চল্ চল্, কারার ঐ লৌহকপাট
- ইসলামী সংগীত – যেমন: তোরা সব জয়ধ্বনি কর, আল্লাহু আল্লাহু
- ভক্তিমূলক গান – যেমন: শ্যামা মায়ের ত্রিনয়ন খুলে দে মা, তোমার পায়ে পরি মা
- প্রেম ও প্রকৃতির গান – যেমন: গাহি সাম্যের গান, পথ চলে যেতে যেতে
তার সুর ও রাগের ব্যবহার ছিল অসাধারণ এবং সংগীতে হিন্দুস্তানী, আরবি, পারসি, ও কাব্যিক ভাষা মিশ্রণ তিনি সফলভাবে প্রয়োগ করেছেন।
🔹 নজরুল ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্য
ব্রিটিশ শাসনের সময় হিন্দু-মুসলিম বিভাজন যখন বাড়ছিল, নজরুল তখন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের বার্তা নিয়ে এসেছিলেন। তিনি লেখেন:
“আমি হিন্দু, আমি মুসলমান — দুই জাতির নয়নমণি, এক বুকে দুই ভালোবাসা নিয়ে আমি কাজী নজরুল ইসলাম!”
নজরুলের এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক করে তোলে। তাঁর রচনায় হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের অসংখ্য চিত্র পাওয়া যায়।
🔹 নজরুলের উপর সমসাময়িক প্রভাব
নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও চিন্তায় সমসাময়িক লেখক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের প্রভাব পড়েছিল। বিশেষ করে:
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে “ধূমকেতু কবি” বলে অভিহিত করেন এবং তার সৃষ্টিকে স্বাগত জানান।
- মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলী – ভারতের খিলাফত আন্দোলনের প্রভাবে নজরুল ইসলাম রাজনৈতিক ও ইসলামী চেতনার দিকে আকৃষ্ট হন।
- ইউরোপীয় বিপ্লবী সাহিত্যে – নেটশে, শেলি, বায়রনের লেখার প্রভাব নজরুলের লেখনীতে লক্ষ্য করা যায়।
🔹 নজরুল চর্চা ও গবেষণা
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান নজরুল গবেষণার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। কিছু উল্লেখযোগ্য সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান:
- নজরুল ইনস্টিটিউট (ঢাকা)
- জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় (ত্রিশাল, বাংলাদেশ)
- নজরুল একাডেমি (কলকাতা, ভারত)
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল স্টাডিজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
🔹 নজরুলের কাব্যভাষা ও ছন্দ
নজরুল ছন্দ ও ভাষায় ছিলেন ব্যতিক্রমী। তিনি বাংলায় আরবি-ফারসি শব্দ যুক্ত করে এক নতুন ভাষার ধারা তৈরি করেন। তিনি প্রচলিত ব্রজবুলি, ঠাকুরবাড়ির সাধু ভাষা ও চলিত রীতিকে ভেঙে নতুন রসায়ন সৃষ্টি করেন। তাঁর কাব্যে মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত ও গীতিকবিতা—সবই ছিল সমান সফল।
🔹 নজরুলের প্রভাব বিশ্বসাহিত্যে
নজরুল শুধু বাংলা ভাষায় সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তাঁর চিন্তা ও লেখা বিশ্বের সাহিত্যিক ও বিপ্লবীদের সাথেও সংযোগ স্থাপন করেছিল। বিভিন্ন ভাষায় তাঁর রচনার অনুবাদ হয়েছে, যেমন:
- ইংরেজি
- উর্দু
- ফার্সি
- হিন্দি
- রাশিয়ান
বিশ্বের বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনে নজরুলের লেখার উদাহরণ টেনে আনা হয়।
🔹 নজরুলকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:
“তোমার ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পড়ে আমি মুগ্ধ। তুমি চিরকাল বিদ্রোহীই থাকো।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান:
“এই কবিই আমাদের জাতীয় চেতনায় আগুন জ্বালিয়েছেন। আমরা তাঁকে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করি।”
সুভাষ চন্দ্র বসু:
“নজরুল ছিলেন তরুণ ভারতবর্ষের কণ্ঠস্বর।”
🔹 ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নজরুলের ভূমিকা
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সাহসী কণ্ঠস্বর। তিনি শুধু কবিতা লিখে নয়, সক্রিয়ভাবে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন।
✊ বিপ্লবী লেখনির মাধ্যমে প্রতিবাদ
নজরুল তার সাহিত্যকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর বিখ্যাত সাময়িকী “ধূমকেতু” প্রকাশের মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশ রাজনীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। পত্রিকাটির এক সংখ্যায় লেখা তাঁর কবিতা “আনন্দময়ীর আগমনে” ব্রিটিশ শাসকদের ক্ষিপ্ত করে তোলে এবং তাঁকে কারাবন্দি করা হয়।
তিনি লিখেছিলেন:
“আর নয় দেরি, এবার মা আসিবে রুদ্ররূপে / শাস্তি দিয়ে লুটে নেবে, বিষধর অসুর দলকে!”
✊ কারাবাস ও প্রতিবাদ
১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ সরকার নজরুলকে গ্রেফতার করে। কারাগারে বসেই তিনি লেখেন:
- “রাজার বন্দী”
- “জেল-জীবনের চিঠি”
- এবং অমর কবিতা “কারার ঐ লৌহ কপাট” যেখানে তিনি বলেন:
“কারার ঐ লৌহকপাট / ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট, রক্ত-জমাট শিকল পুরান!”
এই কবিতা আজও বাঙালির প্রতিবাদের প্রতীক।
🔹 সাহিত্য-সম্পাদক ও সাংবাদিক নজরুল
নজরুল ছিলেন একজন দক্ষ সম্পাদক এবং সাংবাদিকও। তিনি নিজে একাধিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, যেগুলোতে সমাজ, রাজনীতি, ধর্মীয় চিন্তা ও সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে কলাম লিখতেন।
📰 সম্পাদিত পত্রিকাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- ধূমকেতু (১৯২২) – সবচেয়ে প্রভাবশালী, বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ
- লাঙল – কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি সমর্থন
- নবযুগ – সাহিত্য ও রাজনীতির মিশ্র প্রকাশনা
- নবশক্তি – হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রচার করে
এসব পত্রিকায় নজরুল কেবল কবিতা নয়, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বার্তা দিয়েছেন।
🔹 নজরুল ও ইসলামি ভাবধারা
নজরুল ইসলামের মধ্যে ইসলামি ভাবধারা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিনি নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করতেন, এবং ইসলামী সংস্কৃতিকে বাংলা সাহিত্যের মূলধারায় নিয়ে এসেছেন।
☪️ ইসলামি গান ও কবিতায় নজরুল:
- হামদ ও নাত – যেমন:
“আমার কয়লামাখা কালো কাবা, তোরে প্রাণ ভরে চাহি!” - রমজান ও ঈদের গান –
“রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ!” - ইসলামী ইতিহাসভিত্তিক কবিতা –
“খালেদ, তারেক, মু’আবিয়া, ওমর, আলী, হোসেন”-কে নিয়ে লেখা কাব্য
তিনি ইসলামের সৌন্দর্যকে তুলে ধরেন এক উদার, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। তাঁর দৃষ্টিতে ধর্ম ছিল ভ্রাতৃত্ব ও সমতার বাহক, বিভেদের নয়।
🔹 নজরুলের প্রেম ও দাম্পত্য জীবন
নজরুলের প্রেম ও পারিবারিক জীবন ছিল আবেগঘন ও বেদনাবিধুর। তিনি প্রথমে প্রেম করেন নরেশ নারায়ণ রায়ের কন্যা নরিমনকে, কিন্তু তা পূর্ণতা পায়নি।
❤️ পরিণয়:
১৯২৪ সালে তিনি বিয়ে করেন প্রমীলা দেবীকে (আসল নাম: অল্পনা রায়)। প্রমীলা ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের কন্যা, এবং তাঁকে মুসলিম কবির সঙ্গে বিয়ের জন্য অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল মধুর, কিন্তু চরম দারিদ্র্য, নজরুলের অসুস্থতা এবং সন্তান হারা যন্ত্রণায় ছিল ক্লান্তিকর। নজরুল-প্রমীলা দম্পতির চার পুত্র সন্তানের মধ্যে তিনজন অল্প বয়সেই মৃত্যুবরণ করেন।
🔹 নজরুলের অসুস্থতা ও চিকিৎসা
১৯৪২ সালে নজরুল হঠাৎ করে কথা বলা বন্ধ করে দেন। চিকিৎসকরা এটি পিক্স ডিজিজ (Pick’s Disease – একটি নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ) বলে চিহ্নিত করেন। এই রোগে তাঁর মস্তিষ্কের ভাষা কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি প্রায় ৩৪ বছর বাকরুদ্ধ জীবন কাটান, লেখালেখি থেমে যায়। এই সময় তিনি কলকাতা, শিলং, এবং পরে ১৯৭২ সালের পর ঢাকা শহরে জীবন কাটান।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানায় এবং “জাতীয় কবি” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংলগ্ন ধর্মীয় চত্বরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
🔹 নজরুলকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ও ডকুমেন্টারি
🎬 নজরুলের জীবন ও সাহিত্য অবলম্বনে কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ:
- “বিদ্রোহী কবি নজরুল” – বাংলাদেশ টেলিভিশনের ধারাবাহিক অনুষ্ঠান
- “বিদ্রোহী” – একটি তথ্যচিত্র, নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে নির্মিত
- “নজরুল” (ছায়াছবি) – ১৯৮০-এর দশকে ভারতে নির্মিত একটি বায়োপিক
- ইউটিউবে অসংখ্য ডকুমেন্টারি পাওয়া যায়, যেমন:
- BBC Bangla: নজরুলের জীবন
- Deepto TV Special: “নজরুল ও তার বিদ্রোহ”
🔹 নজরুলের স্মৃতিকে কেন্দ্র করে স্থাপনাগুলি
নজরুলের স্মৃতি রক্ষার্থে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হয়েছে পাঠাগার, বিশ্ববিদ্যালয়, মিউজিয়াম, ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র:
- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় – ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ
- নজরুল ইনস্টিটিউট – ঢাকা
- নজরুল মঞ্চ – কলকাতা
- কাজী নজরুল ইসলাম গবেষণা কেন্দ্র – চুরুলিয়া, পশ্চিমবঙ্গ
- কবির সমাধি – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণ
🔹 নজরুলের জনপ্রিয় কবিতা ও গান (উল্লেখযোগ্য তালিকা)
কবিতা | গান |
---|---|
বিদ্রোহী | চল্ চল্ চল্ |
কামাল পাশা | রমজানের ঐ রোজার শেষে |
কাণ্ডারী হুঁশিয়ার | তোমার পূজার ছলে |
লাঙ্গল | আমি চিরকাল বিদ্রোহী |
সাম্যবাদী | গাহি সাম্যের গান |
হিন্দু-মুসলমান | শ্যামা মায়ের ত্রিনয়ন |

🔹 নজরুলের শৈশব ও কৈশোরের দারিদ্র্য: এক জীবন্ত সংগ্রাম
কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিন। পিতার মৃত্যুর পর নজরুলের জীবনে দারিদ্র্য চরমে পৌঁছায়।
🧒 কাজের ছেলেকে কবি বানিয়েছে ক্ষুধা
পিতৃহীন নজরুল খুব অল্প বয়সে স্কুল ছেড়ে দিয়ে কাজ করতে শুরু করেন:
- বেকারি ও রুটির দোকানে কাজ – রানিগঞ্জে মুসলিম বেকারিতে রুটি বানাতেন
- মক্তবের শিক্ষক – স্থানীয় মসজিদে সহকারী মৌলভী হিসেবে কাজ করেন
- লেটো দলে যোগদান – এই দলে গান, কবিতা, নাটক, অভিনয় করতে হতো
এসময়ে তার সাহিত্যচর্চার বীজ রোপিত হয়। লেটো দলে থাকার সময় নজরুল নাট্যগীতি ও লোকসঙ্গীতে পারদর্শিতা অর্জন করেন।
🔹 নজরুলের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদান
বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে নজরুলের অবদান অনেক দিক দিয়ে ব্যতিক্রমী ও যুগান্তকারী।
✍️ সাহিত্যিক বৈচিত্র্য:
- কবিতা – বিদ্রোহ, প্রেম, মানবতা, ধর্মীয় সহাবস্থান, নারীর মুক্তি
- গল্প – ১৯টি ছোটগল্প যেমন ‘বাউণ্ডুলে’, ‘হেনা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’
- উপন্যাস – বাঁধন হারা, কুহেলিকা
- নাটক – আলো ও ছায়া, ঝিলিমিলি
- প্রবন্ধ ও কলাম – যুগবাণী, যুগভেরী, দুর্দিনের যাত্রী
- অনুবাদ সাহিত্য – পবিত্র কোরআনের আয়াত, ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত ইত্যাদি
🎵 বাংলা গানে নজরুলের অবদান:
- প্রায় ৪,০০০+ গান রচনা ও সুরারোপ করেন, যা ‘নজরুলগীতি’ নামে খ্যাত
- গানগুলো বিভিন্ন ধারায়:
- প্রেম, বিরহ, দ্রোহ, দেশপ্রেম, ইসলামি ভাবনা, হিন্দু-ভক্তিমূলক সঙ্গীত
🎶 নজরুল বলেছিলেন:
“আমি হিন্দু-মুসলমান দুই জাতির জন্য গান গাই। কারণ আমি এক চোখে হিন্দু, এক চোখে মুসলমান। আমি চাই না কোনো চোখ অন্ধ হয়ে যাক।”
🔹 নজরুল ও সাম্যবাদ
নজরুল বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী চিন্তা প্রকাশ করেন। তাঁর কবিতায় ধনী-গরিব, জাতপাত, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ রয়েছে।
✊ নজরুলের বিখ্যাত সাম্যবাদী কবিতার অংশ:
“গাহি সাম্যের গান /
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান…”
তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন—
“আমি চির-বিদ্রোহী, আমি অন্ধকারে আলো জ্বালাই, শিকল ছিঁড়ি, আগুন ধরাই।”
🔹 নজরুল ও নারীমুক্তি
বাংলা সাহিত্যে নারীর অধিকার ও মুক্তির বিষয়টি নজরুল ইসলামের লেখায় ব্যতিক্রমী সাহসে প্রকাশ পেয়েছে।
👩🦰 নজরুলের দৃষ্টিতে নারী:
- নারী কেবল প্রেমিকা বা স্ত্রী নয়, বরং বিপ্লবের সহচরী
- তার কবিতায় নারী তেজস্বিনী, বিদ্রোহিনী, মায়েরূপে
কবিতার পঙক্তি:
“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর /
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর!”
🔹 নজরুল ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্য
নজরুল ছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রবক্তা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ধর্ম মানুষকে ভাগ করতে নয়, এক করতে এসেছে।
🕊️ নজরুলের বক্তব্য:
“হিন্দু-মুসলমান দুই ভাই – এক দেহ, এক প্রাণ। তাদের বিচ্ছেদ ঘটানো মানে জাতিকে হত্যা করা।”
তাঁর কবিতা, গান, গল্পে দুই সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য একত্রিত হয়ে উঠে আসে।
🔹 নজরুল ও বিশ্বসাহিত্যের সংযোগ
নজরুল বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের সাহিত্যধারার সঙ্গে যুক্ত করেন। তিনি অনুবাদ করেন:
- পার্সিয়ান কবিতা (ওমর খৈয়াম, সাদী)
- ইংরেজি সাহিত্য (শেলি, মিল্টন, হোমার)
- আরবি সাহিত্য – ইসলামী ইতিহাস
এভাবে বাংলা সাহিত্যকে তিনি আন্তর্জাতিক মাত্রায় নিয়ে যান।
🔹 নজরুল গবেষণা ও আধুনিক প্রভাব
নজরুলের সাহিত্যচর্চা, সঙ্গীত ও চেতনা নিয়ে আজও গবেষণা ও বিতর্ক চলমান। বাংলাদেশ ও ভারত – উভয় দেশে তার উপর অসংখ্য পিএইচডি গবেষণা হয়েছে।
🧑🎓 নজরুল গবেষণা কেন্দ্র:
- বাংলাদেশে: নজরুল ইনস্টিটিউট, বাংলা একাডেমি
- ভারতে: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী
📘 কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ:
- “বিদ্রোহ ও ভালবাসা” – আব্দুল কাদির
- “নজরুল জীবন ও সাহিত্য” – ড. রফিকুল ইসলাম
- “নজরুল: দ্য রেনেসাঁস ম্যান” – মোহিত উল আলম
🔹 নজরুলের মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট, ৭৭ বছর বয়সে নজরুল ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য হারায় এক যুগান্তকারী কবিকে। তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে।
🏅 পরবর্তী সম্মান:
- জাতীয় কবি ঘোষণা
- স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর)
- বাংলাদেশে “নজরুল জয়ন্তী” জাতীয়ভাবে পালন করা হয়
- ভারতের রাষ্ট্রপতি নজরুলের মৃত্যুতে শোকবার্তা প্রেরণ করেন
🔰 কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের ২০টি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা:
১. 🔹 জন্ম – ১৮৯৯
২৫ মে ১৮৯৯ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম কাজী ফকির আহমদ ও মায়ের নাম জাহেদা খাতুন।
২. 🔹 মক্তব শিক্ষার্থী থেকে মসজিদের মোয়াজ্জিন
অল্প বয়সে পিতার মৃত্যু হলে নজরুল মক্তবের শিক্ষক এবং মসজিদের মোয়াজ্জিন হিসেবে কাজ করেন—যেখান থেকে তাঁর ধর্মীয় জ্ঞান ও সঙ্গীত চর্চার সূচনা।
৩. 🔹 লেটো দলে যোগদান
কৈশোরে নজরুল লেটো গানের দলে যোগ দেন, যেখানে তিনি অভিনয়, গানে অংশ নেন। এখানেই সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রতি গভীর অনুরাগ জন্ম নেয়।
৪. 🔹 রুটির দোকানে কাজ
অর্থনৈতিক সংকটে নজরুল রানিগঞ্জের মুসলিম বেকারিতে কাজ করেন – যা তাঁর জীবনের চরম সংগ্রামী দিক তুলে ধরে।
৫. 🔹 স্কুলে পুনঃভর্তির পরে বিদ্যালয় জীবন
দারিরামপুর স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯১৪ সালে ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরে পুনরায় পড়াশোনা চালিয়ে যান মক্তব ও হাইস্কুলে।
৬. 🔹 সেনাবাহিনীতে যোগদান – ১৯১৭
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ ভারতের ৩৯তম বেঙ্গল রেজিমেন্টে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। এই অভিজ্ঞতা তাঁর সাহসিকতা ও লেখায় প্রভাব ফেলে।
৭. 🔹 “বিদ্রোহী” কবিতা প্রকাশ – ১৯২২
তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা “বিদ্রোহী” প্রকাশিত হয় বিজলী পত্রিকায়। এটি তাঁকে বাংলা সাহিত্যে এক বিদ্রোহী কণ্ঠে পরিণত করে।
৮. 🔹 প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ – “অগ্নিবীণা” (১৯২২)
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “অগ্নিবীণা” প্রকাশিত হয়। এতে বিদ্রোহ, দ্রোহ, প্রেম, সাম্যবাদের বার্তা ফুটে ওঠে।
৯. 🔹 “ধূমকেতু” পত্রিকা সম্পাদনা
১৯২২ সালে তিনি সম্পাদনা শুরু করেন পত্রিকা “ধূমকেতু”। এতে সরকারের বিরুদ্ধে লেখার জন্য তাঁকে কারাবরণ করতে হয়।
১০. 🔹 কারাবাস ও “রাজবন্দীর জবানবন্দি” – ১৯২৩
ধূমকেতুতে লেখা কবিতার জন্য নজরুলকে ৬ মাস কারাবরণ করতে হয়। কারাগারে তিনি লেখেন “রাজবন্দীর জবানবন্দি”।
১১. 🔹 ইসলামি গানের সূচনা – “নতুন চাঁদ” কাব্যগ্রন্থ
নজরুল ইসলামি ভাবধারায় কবিতা ও গান রচনা শুরু করেন। প্রকাশিত হয় “নতুন চাঁদ”, যা মুসলিম সমাজে আলোড়ন তোলে।
১২. 🔹 প্রেম ও বিয়ে – ১৯২৪
তিনি প্রমীলা দেবীকে (মূল নাম বসন্তকুমারী) বিয়ে করেন। এটি সে যুগে একটি সাহসী ও প্রগতিশীল পদক্ষেপ ছিল।
১৩. 🔹 নজরুলগীতির রেকর্ডিং – ১৯৩০-এর দশকে
তিনি গ্রামোফোন রেকর্ডে গান রেকর্ড করান। তাঁর লেখা ও সুর করা গান ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
১৪. 🔹 হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের বার্তা
নজরুল তাঁর সাহিত্য ও গান দিয়ে ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। “মসজিদেরই পাশে আমার কালি মন্দির সাঁঝে” প্রভৃতি গানে দুই ধর্মের মেলবন্ধন পাওয়া যায়।
১৫. 🔹 কলকাতায় সাহিত্য ও সঙ্গীত চর্চা
নজরুল ১৯৩০-এর দশকে কলকাতায় স্থায়ী হন এবং সঙ্গীত নাট্যচর্চা ও চলচ্চিত্রে কাজ করেন।
১৬. 🔹 অসুস্থতা ও বাকরুদ্ধতা – ১৯৪২
১৯৪২ সালে নজরুল অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হন এবং বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। এরপর তিনি আর লেখালেখি করতে পারেননি।
১৭. 🔹 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুলকে ডি.লিট প্রদান – ১৯৬০
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি (D.Litt.) প্রদান করে।
১৮. 🔹 বাংলাদেশে নজরুলকে আনা – ১৯৭২
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান নজরুলকে ঢাকা নিয়ে আসেন এবং জাতীয় কবির মর্যাদা দেন।
১৯. 🔹 মৃত্যু – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬
দীর্ঘ অসুস্থতার পর ঢাকায় পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বিএসএমএমইউ) তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
২০. 🔹 রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ
তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয়।
📌 সংক্ষেপে টাইমলাইন চার্ট (ছোট করে):
সাল | ঘটনা |
---|---|
১৮৯৯ | জন্ম |
১৯১৭ | সেনাবাহিনীতে যোগ |
১৯২২ | বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশ |
১৯২৩ | কারাবরণ |
১৯২۴ | প্রমীলা দেবীকে বিয়ে |
১৯৪২ | বাকশক্তি হারানো |
১৯৭২ | বাংলাদেশে আগমন |
১৯৭৬ | মৃত্যু ও সমাধিস্থ |
🔹 উপসংহার
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন এমন এক প্রতিভা, যিনি সাহিত্যের মাধ্যমে বাঙালির আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদাকে জাগ্রত করেছেন। তার বিদ্রোহী মনোভাব, মানবতাবাদী দর্শন ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা আজও আমাদের পথ দেখায়।
🔗 প্রাসঙ্গিক ও নির্ভরযোগ্য রেফারেন্স লিঙ্কসমূহ:
🔸 বাংলাদেশ সরকার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক
- বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন (Bangladesh National Portal)
👉 https://bangladesh.gov.bd/site/page/112d38ba-b8ec-4c2f-a0a5-92ef52d5fc3f/
(নজরুল ইসলামের সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং রাষ্ট্রীয় সম্মান) - বাংলা একাডেমি নজরুল প্রোফাইল
👉 https://www.banglaacademy.gov.bd/?page_id=131 - নজরুল ইনস্টিটিউট (সরকারি প্রতিষ্ঠান)
👉 http://www.nazrulinstitute.gov.bd
(গবেষণা পত্রিকা, নজরুল সঙ্গীত সংগ্রহ, দৃষ্টিভঙ্গি)
🔸 সংবাদ মাধ্যম ও বিশ্বকোষ
- বিকিপিডিয়া (বাংলা) – কাজী নজরুল ইসলাম
👉 https://bn.wikipedia.org/wiki/কাজী_নজরুল_ইসলাম - বিকিপিডিয়া (ইংরেজি) – Kazi Nazrul Islam
👉 https://en.wikipedia.org/wiki/Kazi_Nazrul_Islam - প্রথম আলো – নজরুল বিশেষ সংখ্যা ও প্রবন্ধ
👉 https://www.prothomalo.com/topic/কাজী-নজরুল-ইসলাম - বিডিনিউজ২৪ – নজরুলকে নিয়ে প্রতিবেদন
👉 https://bangla.bdnews24.com/tag/কাজী-নজরুল-ইসলাম
🔸 নজরুল সঙ্গীত ও সাহিত্য সংরক্ষণ
- NazrulGeeti.org – নজরুলগীতি সংগ্রহশালা
👉 https://www.nazrulgeeti.org/ - Nazrul Archive by University of Chicago (Rare English Resources)
👉 https://dsal.uchicago.edu/books/nazrul/
🔸 বিশেষজ্ঞদের প্রবন্ধ ও গবেষণা
- রফিকুল ইসলাম – নজরুল গবেষণা প্রবন্ধ (PDF)
👉 https://www.nazrulinstitute.gov.bd/sites/default/files/files/nazrulinstitute.portal.gov.bd/publications/01bd5d61_8a45_46a7_9a4b_5c7e6c64f2b5/Nazrul_Rafiqul_Islam.pdf - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় – নজরুল স্মারক বক্তৃতা (নজরুল স্মৃতি সংসদ)
👉 https://www.du.ac.bd
🔸 বই বা সংগ্রহ
- “বিদ্রোহ ও ভালবাসা” – আব্দুল কাদির (Book Review)
👉 https://www.goodreads.com/book/show/13634632 - “নজরুল: দ্য রেনেসাঁস ম্যান” – মোহিত উল আলম (Publisher info)
👉 https://www.rokomari.com/book/102002/nazrul-the-renaissance-man
“আরও পড়ুন”