ইতিহাস এবং সংস্কৃতি

প্যালেস্টাইনের ইতিহাস: প্রাচীন ক্যানান থেকে আধুনিক দ্বন্দ্ব পর্যন্ত

প্যালেস্টাইনের ইতিহাস (প্যালেস্টাইনের ইতিহাস) একটি জটিল, বৈচিত্র্যময় এবং গভীর ঐতিহাসিক যাত্রা, যা প্রাচীন ক্যানান (প্রাচীন ক্যানান) থেকে শুরু করে আধুনিক কালের ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্ব (ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্ব) পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অঞ্চলটি পূর্ব ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এবং বর্তমানে এটি আধুনিক ইসরায়েল, গাজা স্ট্রিপ এবং পশ্চিম তীর (ওয়েস্ট ব্যাংক) নিয়ে গঠিত। প্যালেস্টাইনকে ঐতিহাসিকভাবে “পবিত্র ভূমি” (পবিত্র ভূমি) বলা হয়, কারণ এটি ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলিমদের জন্য ধর্মীয়ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নিবন্ধে আমরা প্যালেস্টাইনের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়, গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং প্যালেস্টাইন জাতীয় আন্দোলন (প্যালেস্টাইন জাতীয় আন্দোলন) নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

প্রাচীন ক্যানান এবং প্রাথমিক বসতি

ক্যানানের উৎপত্তি এবং প্রাথমিক জনবসতি

প্যালেস্টাইনের ইতিহাসের শিকড় প্রাচীন ক্যানানে গিয়ে পৌঁছায়, যা বর্তমান ইসরায়েল, প্যালেস্টাইন, লেবানন এবং জর্ডানের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত একটি অঞ্চল। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা যায়, এই অঞ্চলে মানুষের বসতি শুরু হয় প্রায় ১.৫ মিলিয়ন বছর আগে। উবেইদিয়া (Ubeidiya) নামক স্থানে প্রাপ্ত প্রাচীন হাতিয়ার এবং জীবাশ্ম প্রমাণ করে যে হোমো ইরেক্টাস (Homo erectus) আফ্রিকা থেকে এই অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেছিল।

  • প্রাথমিক জীবনযাত্রা:
    • প্রাচীন মানুষ শিকারী-সংগ্রাহক (hunter-gatherers) হিসেবে জীবনযাপন করত। তারা প্রাথমিকভাবে পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করত এবং গুহায় বাস করত।
    • খ্রিস্টপূর্ব ১২,০০০ সালের দিকে নাটুফিয়ান সংস্কৃতি (Natufian culture) গড়ে ওঠে। এই সংস্কৃতি প্যালেস্টাইনে কৃষি বিপ্লবের সূচনা করে। নাটুফিয়ানরা প্রথমবারের মতো বন্য গম এবং বার্লি চাষ শুরু করে।
    • জেরিকো (Jericho) এই সময়ে বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি হিসেবে পরিচিত হয়। এটি খ্রিস্টপূর্ব ৯৬০০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এখানে প্রাচীন পাথরের দেয়াল ও টাওয়ারের নিদর্শন পাওয়া গেছে।

ক্যানানীয় সভ্যতার উত্থান

খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালের দিকে ক্যানানীয়রা (Canaanites) এই অঞ্চলে শহর-রাষ্ট্র গড়ে তোলে। তারা ছিল সেমেটিক জনগোষ্ঠী এবং তাদের সংস্কৃতি প্রভাবিত হয়েছিল প্রাচীন মিশর (প্রাচীন মিশর), মেসোপটেমিয়া এবং সিরিয়ার সভ্যতা দ্বারা। ক্যানানীয়রা বাণিজ্যে দক্ষ ছিল এবং তারা ভূমধ্যসাগরীয় বন্দর শহরগুলোর মাধ্যমে ফিনিশিয়ানদের (Phoenicians) সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল।

  • গুরুত্বপূর্ণ শহর-রাষ্ট্র:
    • জেরিকো: বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি, যেখানে প্রাচীন প্রতিরক্ষা দেয়াল এবং কৃষি ব্যবস্থার নিদর্শন পাওয়া গেছে।
    • হাজোর (Hazor): উত্তর ক্যানানের একটি প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র, যেখানে প্রাচীন প্রাসাদ এবং মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে।
    • মেগিদ্দো (Megiddo): এটি একটি কৌশলগত স্থানে অবস্থিত ছিল এবং প্রাচীন যুদ্ধের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রাচীন জল সরবরাহ ব্যবস্থার নিদর্শন পাওয়া গেছে।
  • সাংস্কৃতিক উন্নয়ন:
    • ক্যানানীয়রা ব্রোঞ্জ যুগে প্রবেশ করে এবং ব্রোঞ্জের অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি তৈরি শুরু করে।
    • তারা দ্রাক্ষা চাষ এবং ওয়াইন উৎপাদনের কৌশল আয়ত্ত করে, যা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
    • ক্যানানীয়রা প্রাচীন লিপি ব্যবহার করত, যা পরবর্তীতে ফিনিশিয়ান বর্ণমালার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
  • ধর্মীয় বিশ্বাস:
    • ক্যানানীয়রা বহুদেববাদী ছিল এবং তাদের প্রধান দেবতা ছিল বাল (Baal), যিনি বৃষ্টি ও উর্বরতার দেবতা হিসেবে পূজিত হতেন।
    • দেবী আশেরা (Ashera) ছিলেন উর্বরতা ও মাতৃত্বের দেবী, এবং তার পূজা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।
    • তারা প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন দেবতার পূজা করত এবং ধর্মীয় উৎসবের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন উদযাপন করত।

ইসরায়েলীদের আগমন এবং রাজ্য প্রতিষ্ঠা

ইসরায়েলীদের আগমন এবং ফিলিস্তিনদের উত্থান

খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সালের দিকে ইসরায়েলীয়রা (Israelites) ক্যানানে আসে। তাদের উৎপত্তি নিয়ে ঐতিহাসিক মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন তারা মিশর থেকে পালিয়ে এসেছিল (যেমন বাইবেলে বর্ণিত এক্সোডাস), আবার কেউ মনে করেন তারা স্থানীয় ক্যানানীয় জনগোষ্ঠীর একটি শাখা ছিল। এই সময়ে ফিলিস্তিনরাও (Philistines) এজিয়ান অঞ্চল থেকে এসে দক্ষিণ উপকূলে বসতি স্থাপন করে। ফিলিস্তিনদের নাম থেকেই পরবর্তীতে “প্যালেস্টাইন” নামটি এসেছে।

  • ইসরায়েলীদের জীবনযাত্রা:
    • তারা প্রাথমিকভাবে গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজে বাস করত এবং ১২টি গোত্রে বিভক্ত ছিল, যারা পিতৃপুরুষ অব্রাহাম (Abraham) এর বংশধর বলে দাবি করত।
    • তারা একেশ্বরবাদী ধর্ম পালন করত এবং ইয়াহওয়ে (Yahweh) নামক দেবতার উপাসনা করত।
    • ইসরায়েলীয়রা ক্যানানীয়দের সাথে প্রায়ই সংঘর্ষে জড়াত, বিশেষ করে ফিলিস্তিনদের সাথে।
  • ফিলিস্তিনদের প্রভাব:
    • ফিলিস্তিনরা লোহার অস্ত্র তৈরির কৌশল নিয়ে আসে, যা তাদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব দেয়।
    • তারা পাঁচটি প্রধান শহরে বসতি স্থাপন করে: গাজা, আশকেলন, আশদোদ, একরন এবং গাথ।
    • ফিলিস্তিনরা ওয়াইন উৎপাদন এবং সমুদ্র বাণিজ্যে দক্ষ ছিল।

ইসরায়েল ও জুডাহ রাজ্যের উত্থান

খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে ইসরায়েলীয়রা দুটি সম্পর্কিত রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে: উত্তরে ইসরায়েল রাজ্য (Israel) এবং দক্ষিণে জুডাহ রাজ্য (Judah)। এই সময়ে রাজা শৌল (Saul), রাজা ডেভিড (David) এবং রাজা সলোমন (Solomon) এই অঞ্চল শাসন করেন।

  • ইসরায়েল রাজ্য:
    • এটি ছিল আরও সমৃদ্ধ এবং একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠে। এর রাজধানী ছিল সামারিয়া (Samaria)।
    • রাজা ওমরি (Omri) এবং তার পুত্র আহাব (Ahab) এই রাজ্যের শক্তিশালী শাসক ছিলেন। আহাবের স্ত্রী জেজেবেল (Jezebel) বাল দেবতার পূজা প্রচার করেন, যা ইসরায়েলীয় ধর্মীয় নেতাদের সাথে সংঘর্ষের কারণ হয়।
    • ইসরায়েল রাজ্য খ্রিস্টপূর্ব ৭২২ সালে আসিরিয়ানদের (Assyrians) দ্বারা ধ্বংস হয়, এবং এর জনগণ নির্বাসিত হয় (Ten Lost Tribes)।
  • জুডাহ রাজ্য:
    • জুডাহ ছিল তুলনামূলকভাবে দুর্বল, তবে জেরুজালেম এর রাজধানী হিসেবে এটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
    • রাজা ডেভিড জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার পুত্র সলোমন প্রথম মন্দির (First Temple) নির্মাণ করেন।
    • জুডাহ রাজ্য খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল, যতক্ষণ না ব্যাবিলনীয়রা এটি ধ্বংস করে।

ব্যাবিলনীয়, পারসিক এবং হেলেনিস্টিক শাসন

ব্যাবিলনীয় বিজয় এবং নির্বাসন

খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীতে আসিরিয়ানরা ইসরায়েল রাজ্য ধ্বংস করে। পরবর্তীতে, খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৭ সালে ব্যাবিলনীয় রাজা নেবুচাদনেজার (Nebuchadnezzar II) জুডাহ রাজ্য জয় করে। তিনি জেরুজালেমের প্রথম মন্দির ধ্বংস করেন এবং ইহুদিদের ব্যাবিলনে নির্বাসিত করেন, যা ব্যাবিলনীয় নির্বাসন (Babylonian Exile) নামে পরিচিত।

  • নির্বাসনের প্রভাব:
    • ইহুদিরা ব্যাবিলনে তাদের ধর্মীয় পরিচয় ধরে রাখে এবং এই সময়ে তাদের ধর্মগ্রন্থ সংকলনের কাজ শুরু হয়।
    • নির্বাসনের সময় ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে সিনাগগ (Synagogue) ব্যবস্থার উদ্ভব হয়।

পারসিক শাসন এবং পুনরুদ্ধার

খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালে পারসিক আকিমিনিড সাম্রাজ্যের (Achaemenid Empire) রাজা সাইরাস দ্য গ্রেট (Cyrus the Great) ব্যাবিলন জয় করেন। তিনি ইহুদিদের জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন এবং দ্বিতীয় মন্দির (Second Temple) নির্মাণের জন্য সহায়তা প্রদান করেন।

  • পারসিক শাসনের বৈশিষ্ট্য:
    • পারসিকরা স্থানীয় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি সহনশীল ছিলেন।
    • এই সময়ে ইহুদি সম্প্রদায় পুনর্গঠিত হয় এবং তাদের ধর্মীয় আইন (Torah) প্রতিষ্ঠিত হয়।

হেলেনিস্টিক শাসন এবং ম্যাকাবিয়ান বিদ্রোহ

খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৩ সালে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট (Alexander the Great) পারসিক সাম্রাজ্য জয় করেন এবং প্যালেস্টাইন তার হেলেনিস্টিক সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে ওঠে। তার মৃত্যুর পর, এই অঞ্চলটি প্রথমে টলেমীয় (Ptolemaic) এবং পরে সেলুসিড (Seleucid) সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়।

  • হেলেনিস্টিক সংস্কৃতির প্রভাব:
    • গ্রিক ভাষা এবং সংস্কৃতি (Hellenization) এই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। জিমনেসিয়াম এবং থিয়েটার নির্মিত হয়।
    • কিছু ইহুদি গ্রিক সংস্কৃতি গ্রহণ করে, যা ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল ইহুদিদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
  • ম্যাকাবিয়ান বিদ্রোহ:
    • খ্রিস্টপূর্ব ১৬৭ সালে সেলুসিড শাসক অ্যান্টিওকাস চতুর্থ (Antiochus IV) ইহুদি ধর্মীয় প্রথা নিষিদ্ধ করেন এবং জেরুজালেমের মন্দিরে গ্রিক দেবতা জিউসের মূর্তি স্থাপন করেন।
    • এর প্রতিক্রিয়ায় ম্যাকাবিয়ান বিদ্রোহ (Maccabean Revolt) শুরু হয়, যার নেতৃত্ব দেন জুডাহ ম্যাকাবি (Judah Maccabee)।
    • বিদ্রোহ সফল হয় এবং হাসমোনিয়ান রাজবংশ (Hasmonean dynasty) প্রতিষ্ঠিত হয়, যারা খ্রিস্টপূর্ব ১৪০ থেকে ৬৩ সাল পর্যন্ত শাসন করে।

রোমান এবং বাইজান্টাইন শাসন

রোমান শাসন এবং বিদ্রোহ

খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে রোমান সেনাপতি পম্পে (Pompey) প্যালেস্টাইন জয় করেন এবং এটি রোমান সাম্রাজ্যের (Roman Empire) জুডিয়া (Judaea) প্রদেশ হিসেবে পরিচিত হয়। রোমান শাসনের সময় ইহুদিদের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।

  • প্রথম ইহুদি-রোমান যুদ্ধ (66-73 CE):
    • ইহুদিরা রোমান শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। রোমানরা ৭০ সালে জেরুজালেম দখল করে এবং দ্বিতীয় মন্দির ধ্বংস করে।
    • মাসাদা (Masada) দুর্গে শেষ ইহুদি প্রতিরোধ ৭৩ সাল পর্যন্ত চলে, যেখানে বিদ্রোহীরা গণ আত্মহত্যা করে।
  • বার কোখবা বিদ্রোহ (132-136 CE):
    • সিমন বার কোখবা (Simon Bar Kokhba) এর নেতৃত্বে ইহুদিরা আবার বিদ্রোহ করে।
    • রোমান সম্রাট হ্যাড্রিয়ান (Hadrian) এই বিদ্রোহ দমন করে এবং জুডিয়ার নাম পরিবর্তন করে সিরিয়া প্যালেস্টিনা (Syria Palaestina) রাখেন।
    • এই সময়ে অনেক ইহুদিকে নির্বাসিত করা হয় এবং জেরুজালেমে ইহুদিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।

বাইজান্টাইন শাসন এবং খ্রিস্টধর্মের উত্থান

৪র্থ শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্য বিভক্ত হলে প্যালেস্টাইন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের (Byzantine Empire) অংশ হয়। সম্রাট কনস্টান্টাইন (Constantine) ৩১৩ সালে খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন, এবং প্যালেস্টাইন খ্রিস্টান তীর্থস্থান হিসেবে গুরুত্ব পায়।

  • খ্রিস্টান স্থাপত্য:
    • জেরুজালেমে চার্চ অফ দ্য হোলি সেপালকার (Church of the Holy Sepulchre) নির্মিত হয়, যেখানে যিশু খ্রিস্টের সমাধি রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
    • বেথলেহেমে চার্চ অফ দ্য ন্যাটিভিটি (Church of the Nativity) নির্মিত হয়, যেখানে যিশু খ্রিস্টের জন্ম হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
  • সামাজিক পরিবর্তন:
    • খ্রিস্টধর্ম এই অঞ্চলে প্রভাবশালী ধর্মে পরিণত হয়, তবে ইহুদি এবং সামারিটান (Samaritan) সম্প্রদায়ও উপস্থিত ছিল।
    • বাইজান্টাইন শাসকরা ইহুদিদের উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে, যার ফলে সামারিটান বিদ্রোহ (Samaritan Revolts) সংঘটিত হয়।
palestine

আরব বিজয় এবং ইসলামিক খিলাফত

আরব বিজয় এবং ইসলামের প্রসার

৭ম শতাব্দীতে রশিদুন খিলাফত (Rashidun Caliphate) প্যালেস্টাইন জয় করে। ৬৩৬ সালে ইয়ারমুকের যুদ্ধে (Battle of Yarmouk) তারা বাইজান্টাইন সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে এবং এই অঞ্চল ইসলামিক শাসনের অধীনে আসে।

  • ইসলামিক শাসনের প্রথম পর্যায়:
    • খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (Umar ibn al-Khattab) ৬৩৮ সালে জেরুজালেমে প্রবেশ করেন এবং তিনি খ্রিস্টান ও ইহুদিদের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেন।
    • এই সময়ে জেরুজালেম ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম শহর হিসেবে পরিচিত হয়।
  • উমাইয়া খিলাফত (Umayyad Caliphate):
    • উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক (Abdul Malik) ৬৯১ সালে ডোম অফ দ্য রক (Dome of the Rock) নির্মাণ করেন।
    • আল-আকসা মসজিদ (Al-Aqsa Mosque) এই সময়ে পুনর্নির্মাণ করা হয় এবং এটি মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থানে পরিণত হয়।
  • আব্বাসীয় এবং ফাতিমীয় শাসন:
    • আব্বাসীয় খিলাফত (Abbasid Caliphate) প্যালেস্টাইনকে তাদের সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করে।
    • ফাতিমীয় খিলাফত (Fatimid Caliphate) ১০ম শতাব্দীতে প্যালেস্টাইন শাসন করে এবং তারা শিয়া ইসলামের প্রচার করে।

ইসলামিক সংস্কৃতির প্রভাব

ইসলামিক শাসনের সময় প্যালেস্টাইন আরব সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয়। আরবি ভাষা এই অঞ্চলের প্রধান ভাষা হয়ে ওঠে এবং ইসলামিক স্থাপত্য ও শিল্প এখানে বিকশিত হয়।

  • শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা:
    • জেরুজালেমে ইসলামিক শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে ওঠে, যেখানে হাদিস, ফিকহ এবং কুরআনের অধ্যয়ন করা হত।
    • প্যালেস্টাইনীয় পণ্ডিতরা ইসলামিক বিজ্ঞান ও সাহিত্যে অবদান রাখেন।
  • ধর্মীয় সহনশীলতা:
    • ইসলামিক শাসকরা খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দেন, তবে তারা জিজিয়া (Jizya) নামক কর দিতে বাধ্য ছিল।
    • জেরুজালেমে তিনটি ধর্মের সম্প্রদায় একসাথে বসবাস করত, যা এই শহরকে একটি বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত করে।

ক্রুসেড এবং মধ্যযুগ

ক্রুসেডারদের আগমন

১০৯৫ সালে পোপ আরবান দ্বিতীয় (Pope Urban II) প্রথম ক্রুসেড (First Crusade) ডাক দেন, এবং ১০৯৯ সালে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করে। তারা জেরুজালেম রাজ্য (Kingdom of Jerusalem) প্রতিষ্ঠা করে এবং প্যালেস্টাইনের বিভিন্ন অংশে খ্রিস্টান শাসন প্রতিষ্ঠা করে।

  • ক্রুসেডের প্রভাব:
    • ক্রুসেডাররা জেরুজালেমে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়, যার মধ্যে মুসলিম এবং ইহুদি জনগণও ছিল।
    • তারা খ্রিস্টান স্থাপত্য নির্মাণ করে, যেমন জেরুজালেমে নতুন গীর্জা এবং দুর্গ।
  • সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর প্রতিরোধ:
    • ১১৮৭ সালে আইয়ুবী সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী (Salahuddin Ayyubi) হাত্তিনের যুদ্ধে (Battle of Hattin) ক্রুসেডারদের পরাজিত করেন।
    • তিনি জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন এবং খ্রিস্টানদের প্রতি সহনশীলতা দেখান, তাদের ধর্মীয় স্থানে প্রবেশের অনুমতি দেন।

মামলুক শাসন

১৩শ শতাব্দীতে মামলুকরা (Mamluks) প্যালেস্টাইন শাসন করে। তারা ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং ১২৯১ সালে আক্কা (Acre) দখল করে ক্রুসেডারদের শেষ ঘাঁটি ধ্বংস করে।

  • মামলুকদের শাসন ব্যবস্থা:
    • মামলুকরা ইসলামিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে এবং জেরুজালেমে মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ করে।
    • তারা মঙ্গোল আক্রমণ (Mongol invasions) প্রতিহত করে এবং আইন আল-জালুতের যুদ্ধে (Battle of Ain Jalut) তাদের পরাজিত করে।
প্যালেস্টাইনের ইতিহাস-history of palestine

অটোমান শাসন

১৫১৬ সালে অটোমান সাম্রাজ্য (Ottoman Empire) মামলুকদের পরাজিত করে এবং প্যালেস্টাইন তাদের শাসনাধীনে আসে। অটোমানরা ৪০০ বছরেরও বেশি সময় এই অঞ্চল শাসন করে।

  • অটোমান শাসনের বৈশিষ্ট্য:
    • জেরুজালেম ধর্মীয় তীর্থস্থান হিসেবে গুরুত্ব বজায় রাখে। সুলতান সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট (Suleiman the Magnificent) জেরুজালেমের দেয়াল পুনর্নির্মাণ করেন।
    • অটোমানরা মিলেট সিস্টেম (Millet system) প্রয়োগ করে, যার মাধ্যমে খ্রিস্টান এবং ইহুদি সম্প্রদায়কে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়।
    • এই সময়ে প্যালেস্টাইনের জনসংখ্যা প্রধানত আরব মুসলিম হয়ে ওঠে, তবে খ্রিস্টান এবং ইহুদি সম্প্রদায়ও উপস্থিত ছিল।
  • সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন:
    • প্যালেস্টাইনের গ্রামগুলোতে কৃষি প্রধান অর্থনীতি ছিল। জলপাই, দ্রাক্ষা এবং গম এই অঞ্চলের প্রধান ফসল ছিল।
    • নাবলুস (Nablus) শহর সাবান তৈরির জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে, যা অটোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে রপ্তানি করা হত।

ব্রিটিশ ম্যান্ডেট

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (First World War) অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯২২ সালে লীগ অফ নেশনস (League of Nations) ব্রিটিশদের প্যালেস্টাইনে ম্যান্ডেট (British Mandate) প্রদান করে। এই সময়ে জায়নবাদী আন্দোলন (Zionist movement) গতি পায় এবং ইহুদি অভিবাসন বৃদ্ধি পায়।

  • বেলফোর ঘোষণা:
    • ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব আর্থার বেলফোর (Arthur Balfour) বেলফোর ঘোষণা (Balfour Declaration) জারি করেন, যেখানে ইহুদিদের জন্য প্যালেস্টাইনে একটি জাতীয় আবাস (National Home) গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
    • এই ঘোষণা আরব জনগণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে, কারণ তারা এই অঞ্চলে একটি স্বাধীন আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি আশা করেছিল।
  • আরব-ইহুদি উত্তেজনা:
    • ১৯২০ এবং ১৯২৯ সালে জেরুজালেমে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ১৯২৯ সালে হেবরন (Hebron) দাঙ্গায় ৬৭ জন ইহুদি নিহত হয়।
    • ১৯৩৬-১৯৩৯ সালে আরব বিদ্রোহ (Arab Revolt) সংঘটিত হয়, যেখানে আরবরা ব্রিটিশ শাসন এবং ইহুদি অভিবাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে।

ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং নাকবা

১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ (United Nations) প্যালেস্টাইনকে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার প্রস্তাব দেয় (UN Partition Plan): একটি ইহুদি রাষ্ট্র এবং একটি আরব রাষ্ট্র। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র (State of Israel) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ঘটনা প্যালেস্টাইনীয়দের জন্য নাকবা (Nakba) বা “বিপর্যয়” হিসেবে পরিচিত।

  • নাকবার বিবরণ:
    • ১৯৪৭-১৯৪৮ সালে ইহুদি মিলিশিয়া গোষ্ঠী যেমন হাগানাহ (Haganah) এবং ইরগুন (Irgun) প্যালেস্টাইনীয় গ্রামগুলোতে আক্রমণ চালায়।
    • ডেইর ইয়াসিন (Deir Yassin) গণহত্যায় ১০০ জনেরও বেশি প্যালেস্টাইনীয় নিহত হয়, যা ব্যাপক আতঙ্ক ছড়ায়।
    • প্রায় ৭০০,০০০ প্যালেস্টাইনীয় বাস্তুচ্যুত হয় এবং তারা পশ্চিম তীর, গাজা স্ট্রিপ, জর্ডান, লেবানন এবং সিরিয়ায় শরণার্থী হয়।
  • শরণার্থী জীবন:
    • শরণার্থীরা জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা UNRWA (United Nations Relief and Works Agency) এর সাহায্যে শরণার্থী শিবিরে বসবাস শুরু করে।
    • অনেকে তাদের গ্রামে ফিরে যাওয়ার অধিকার (Right of Return) দাবি করে, যা এখনও একটি বিতর্কিত বিষয়।

ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্ব

প্রধান যুদ্ধ এবং সংঘর্ষ

  • ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ:
    • ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পরপরই মিশর, জর্ডান, সিরিয়া এবং লেবাননের সমন্বিত আরব বাহিনী ইসরায়েল আক্রমণ করে।
    • ইসরায়েল যুদ্ধে জয়ী হয় এবং জাতিসংঘের পরিকল্পনার চেয়ে অতিরিক্ত ভূখণ্ড দখল করে।
  • ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ (Six-Day War):
    • ইসরায়েল পশ্চিম তীর, গাজা স্ট্রিপ, পূর্ব জেরুজালেম, সিনাই উপদ্বীপ এবং গোলান মালভূমি দখল করে।
    • এই যুদ্ধের ফলে প্যালেস্টাইনীয়দের আরও বাস্তুচ্যুতি ঘটে এবং ইসরায়েলি দখলদারিত্ব শুরু হয়।
  • প্রথম ইন্তিফাদা (1987-1993):
    • প্যালেস্টাইনীয়রা ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে অহিংস এবং সহিংস প্রতিবাদ শুরু করে।
    • এই সময়ে পাথর নিক্ষেপ এবং ধর্মঘট ইন্তিফাদার প্রতীক হয়ে ওঠে।
  • দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (2000-2005):
    • আরিয়েল শ্যারন (Ariel Sharon) এর আল-আকসা মসজিদ পরিদর্শনের পর এই বিদ্রোহ শুরু হয়।
    • এই সময়ে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, যার মধ্যে আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং ইসরায়েলি সামরিক অভিযান অন্তর্ভুক্ত ছিল।

হামাস এবং ফাতাহ

২০০৭ সালে হামাস (Hamas) গাজা স্ট্রিপের নিয়ন্ত্রণ নেয়, যখন ফাতাহ (Fatah) পশ্চিম তীরে প্যালেস্টাইনীয় কর্তৃপক্ষ (Palestinian Authority) পরিচালনা করে।

  • হামাস:
    • হামাস ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে পরিচিত।
    • তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে এবং গাজায় সামাজিক সেবা প্রদান করে।
  • ফাতাহ:
    • ফাতাহ প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (PLO) প্রধান দল এবং এটি ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন হিসেবে পরিচিত।
    • ফাতাহ কূটনৈতিক সমাধান এবং আলোচনার পক্ষে বেশি।

প্যালেস্টাইন জাতীয় আন্দোলন

১৯৬৪ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (PLO) প্রতিষ্ঠিত হয়, যার লক্ষ্য ছিল প্যালেস্টাইনীয়দের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন।

  • ইয়াসির আরাফাতের ভূমিকা:
    • ইয়াসির আরাফাত (Yasser Arafat) ১৯৬৯ সালে PLO-এর চেয়ারম্যান হন এবং তিনি প্যালেস্টাইনীয় আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠেন।
    • ১৯৮৮ সালে তিনি প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র ঘোষণা করেন এবং ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি (Oslo Accords) স্বাক্ষর করেন।
  • অসলো চুক্তি:
    • এই চুক্তি প্যালেস্টাইনীয়দের পশ্চিম তীর এবং গাজার কিছু অংশে সীমিত স্বায়ত্তশাসন দেয়।
    • চুক্তির মাধ্যমে প্যালেস্টাইনীয় কর্তৃপক্ষ (Palestinian Authority) প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • আধুনিক আন্দোলন:
    • প্যালেস্টাইনীয়রা জাতিসংঘে পূর্ণ সদস্যপদ লাভের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ২০১২ সালে প্যালেস্টাইনকে জাতিসংঘে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
    • BDS আন্দোলন (Boycott, Divestment, Sanctions) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য গঠিত হয়।

প্যালেস্টাইনের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ইতিহাস

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য

প্যালেস্টাইনের সাংস্কৃতি বিভিন্ন সভ্যতার মিশ্রণে গড়ে উঠেছে। এই অঞ্চলের সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত এবং খাবার সারা বিশ্বে পরিচিত।

  • সাহিত্য ও কবিতা:
    • মাহমুদ দারউইশ (Mahmoud Darwish) প্যালেস্টাইনের জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিত। তার কবিতা “আইডেন্টিটি কার্ড” (Identity Card) প্যালেস্টাইনীয় সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠে। তিনি তার কবিতায় প্যালেস্টাইনীয়দের বাস্তুচ্যুতি, পরিচয় এবং প্রতিরোধের গল্প তুলে ধরেন। দারউইশের কবিতা প্রায়ই স্বাধীনতা ও শান্তির আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করে, যা তাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি দিয়েছে।
    • ফাদওয়া তুকান (Fadwa Tuqan) আরেকজন বিখ্যাত কবি, যিনি প্যালেস্টাইনীয় নারীদের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন। তার কবিতা “দ্য রক অফ জেরুজালেম” (The Rock of Jerusalem) প্যালেস্টাইনীয় নারীদের সংগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি নারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধের কষ্ট ও আশার গল্প বলেছেন।
    • সমর আল-আত্তার (Samar al-Attar) এবং ইব্রাহিম তুকান (Ibrahim Tuqan) এর মতো লেখকরাও প্যালেস্টাইনীয় সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ইব্রাহিম তুকানের “ম্যার্চ সাং” (March Song) প্যালেস্টাইনীয় জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
  • নৃত্য ও সঙ্গীত:
    • ডাবকে (Dabke) একটি ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্য, যা বিবাহ, উৎসব এবং সামাজিক সমাবেশে পরিবেশিত হয়। এটি গ্রামীণ সম্প্রদায়ের ঐক্য ও আনন্দের প্রতীক। ডাবকে-তে নৃত্যকাররা একটি সারিতে দাঁড়িয়ে পায়ের তালে তাল মিলিয়ে নৃত্য করে, যা সাধারণত ঢোল ও ফ্লুটের সঙ্গে সম্পন্ন হয়।
    • আতাবা (Ataaba) এবং মিজানা (Mijana) গান প্যালেস্টাইনীয় সংস্কৃতির অংশ, যেখানে প্রেম, ক্ষতি এবং প্রতিরোধের গল্প বর্ণিত হয়। আতাবা একটি কবিতার মতো গান, যা সাধারণত গ্রামীণ এলাকায় গাওয়া হয়।
    • আধুনিক সময়ে রেমি বান্ধোব (Rami Bandak) এবং মহম্মদ আসাদ (Mohammad Assaf) এর মতো গায়করা প্যালেস্টাইনীয় সঙ্গীতকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেছেন। মহম্মদ আসাদ ২০১৩ সালে আরাব আইডল জয়ী হয়ে প্যালেস্টাইনীয় গর্ব বাড়িয়েছেন।
  • সূচিকর্ম এবং হস্তশিল্প:
    • প্যালেস্টাইনীয় সূচিকর্ম (Palestinian embroidery) ইউনেসকোর অস্পর্শ ঐতিহ্য তালিকায় স্থান পেয়েছে। নারীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক (থোব) এবং ব্যাগে জ্যামিতিক নকশা তৈরি করে। এই নকশাগুলো প্রতিটি অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রকাশ করে, যেমন হেবরনের লাল ও কালো সূতা বা বেথলেহেমের সোনালি সূচিকর্ম।
    • নাবলুসে হস্তনির্মিত সাবান এবং হেবরনে কাচের পণ্য ত�ৈরি একটি প্রাচীন শিল্প। নাবলুসের সাবান জলপাই তেল দিয়ে তৈরি হয় এবং এটি প্রাকৃতিক উপাদানের জন্য বিখ্যাত।
    • মোটিফ (Motif) নামে একটি প্রাচীন শিল্প আছে, যেখানে পাথরে খোদাই করে নকশা তৈরি করা হয়, যা জেরুজালেমের প্রাচীন স্থাপত্যে দেখা যায়।
  • খাবার ও রান্না:
    • প্যালেস্টাইনীয় খাবারে জলপাই তেল, জাতার (Za’atar), এবং হুমমুস (Hummus) গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জাতার একটি ঐতিহ্যবাহী মশলা, যা তিমুর, তুলসী এবং সুমাক দিয়ে তৈরি হয়।
    • মুসাখান (Musakhan) একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার, যেখানে মুরগি, পেঁয়াজ এবং সুমাক মশলা দিয়ে রান্না করা হয়। এটি প্যালেস্টাইনের গ্রামীণ এলাকায় উৎসবের সময় পরিবেশিত হয়।
    • কুনাফা (Kunafeh) একটি জনপ্রিয় মিষ্টি, যা পনির ও শীতকর ভাজা দিয়ে তৈরি হয়। এটি নাবলুসে বিশেষভাবে জনপ্রিয় এবং প্যালেস্টাইনীয় পরিবারের উৎসবে প্রায়ই খাওয়া হয়।
    • মাংসের খাবারে মুশাফফা (Mushaaffa) এবং মানসাফ (Mansaf) গুরুত্বপূর্ণ, যা বিশেষত পশ্চিম তীরে জনপ্রিয়।

সামাজিক কাঠামো

প্যালেস্টাইনীয় সমাজে গ্রামীণ এবং শহুরে জীবনযাত্রার একটি সুন্দর সমন্বয় রয়েছে। এই সমাজ ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ এবং আধুনিক প্রভাবের মধ্যে সন্তुलন রক্ষা করে।

  • গ্রামীণ জীবন:
    • প্যালেস্টাইনের গ্রামগুলো প্রাচীন কাল থেকে কৃষি ও পশুপালনের উপর নির্ভরশীল। জলপাই বাগান, আঙুরের চাষ এবং মৌমাছি পালন এখানে সাধারণ।
    • গ্রামীণ সম্প্রদায়ে পরিবারের ঐক্য ও সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামের নেতা (মুখতার) স্থানীয় সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতেন।
    • বাড়িগুলো প্রায়ই পাথর দিয়ে তৈরি এবং এটি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
  • শহুরে জীবন:
    • জেরুজালেম, নাবলুস, এবং হেবরনের মতো শহরগুলো বাণিজ্য ও শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। জেরুজালেমের পুরাতন বাজার (Old City Bazaar) এখনও ব্যস্ত।
    • শহরে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় একসাথে বসবাস করে, যা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তৈরি করে।
  • শরণার্থী জীবন:
    • ১৯৪৮-এর নাকবার পর প্রায় ৫০০টিরও বেশি শরণার্থী শিবির স্থাপিত হয়, যেমন জবালিয়া (Jabalia) এবং রাফাহ (Rafah)। এখানে ১৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ বসবাস করে।
    • শরণার্থীদের জীবন কঠিন, তবে তারা শিক্ষা এবং শিল্পের মাধ্যমে তাদের পরিচয় ধরে রাখে। UNRWA শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং খাদ্য সরবরাহ করে।
    • শরণার্থী সম্প্রদায়ে গল্পকথা, গান এবং চিত্রকলা প্যালেস্টাইনীয় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব

প্যালেস্টাইনের ইতিহাসে বেশ কিছু ব্যক্তি তাদের অবদানে উল্লেখযোগ্য।

  • সালাহউদ্দিন আইয়ুবী (Salahuddin Ayyubi):
    • ১১২৭-১১৯৩ সালে জন্মগ্রহণকারী সালাহউদ্দিন একজন মুসলিম যোদ্ধা এবং সুলতান ছিলেন। তিনি ক্রুসেডের বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন।
    • তিনি তাদের ন্যায়পরায়ণতা এবং সহানুভূতির জন্য বিখ্যাত, যখন তিনি জেরুজালেমের ক্রুসেডারদের জীবন বাঁচিয়ে দেন।
  • ইয়াসির আরাফাত (Yasser Arafat):
    • ১৯২৯-২০০৪ সালে জীবন কাটানো আরাফাত প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (PLO) নেতা ছিলেন।
    • তিনি প্যালেস্টাইনীয় জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে ওঠেন এবং ১৯৯৪ সালে শান্তি প্রচেষ্টার জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
  • হানান আশরাউই (Hanan Ashrawi):
    • একজন প্যালেস্টাইনীয় নেত্রী ও কবি, যিনি প্যালেস্টাইনীয় কর্তৃপক্ষে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
    • তিনি মহিলা অধিকার এবং শান্তি প্রচারে কাজ করেন এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্যালেস্টাইনীয় কারণ উপস্থাপন করেন।
  • রশিদা তাহ্লা (Rashida Tlaib):
    • একজন আধুনিক প্যালেস্টাইনীয়-আমেরিকান রাজনীতিবিদ, যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে নির্বাচিত হন। তিনি প্যালেস্টাইনীয় অধিকারের জন্য কণ্ঠ উত্থাপন করেন।

উপসংহার

প্যালেস্টাইনের ইতিহাস হলো সংঘাত, সংস্কৃতি এবং সংগ্রামের একটি দীর্ঘ গল্প। প্রাচীন ক্যানান থেকে শুরু করে আধুনিক ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্ব পর্যন্ত, এই অঞ্চলটি বিভিন্ন সভ্যতা, ধর্ম এবং জাতির মিলনস্থল হয়ে উঠেছে। প্রতিটি যুগে প্যালেস্টাইনীয়রা তাদের পরিচয় ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে সংগ্রাম করেছে।

  • প্রাচীন কাল: ক্যানানীয়রা এই অঞ্চলের প্রথম শহর গড়ে তুলেছিলেন, যা পরবর্তী সভ্যতার ভিত্তি হয়ে ওঠে।
  • ধর্মীয় গুরুত্ব: জেরুজালেম তিনটি ধর্মের পবিত্রতা নিয়ে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
  • আধুনিক সংগ্রাম: নাকবা থেকে শুরু করে ইন্তিফাদা এবং জাতীয় আন্দোলন, প্যালেস্টাইনীয়রা স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
  • সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য: সাহিত্য, সঙ্গীত, এবং খাবার প্যালেস্টাইনীয় পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

আজ, ২০২৫ সালের মে মাসে, প্যালেস্টাইনীয়রা তাদের জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনের প্রতীক্ষায় রয়েছেন। এই নিবন্ধটি পড়ে আপনি প্যালেস্টাইনের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সংগ্রাম সম্পর্কে গভীর ধারণা পেয়েছেন বলে আমি আশা করি। প্যালেস্টাইনের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নির্ভর করছে শান্তি ও ন্যায়ের দিকে সমস্ত পক্ষের সহযোগিতার উপর।

Here are some related links that provide further information on the history of Palestine :

  • Bangladesh–Palestine Relations (Wikipedia)
    This page details the historical and ongoing relationship between Bangladesh and Palestine, including Bangladesh’s support for Palestinian statehood and cultural ties.
    Link: https://en.wikipedia.org/wiki/Bangladesh–Palestine_relations
  • History of the Question of Palestine (United Nations)
    A comprehensive timeline of events related to Palestine, from the British Mandate to modern conflicts, provided by the UN.
    Link: https://www.un.org/unispal/history/
  • Palestine Embassy in Bangladesh
    The official website of the Palestine Embassy in Bangladesh offers insights into Palestine’s history and its diplomatic relations with Bangladesh.
    Link: http://palestinemissionbd.com/
  • Decolonize Palestine
    A resource hub with articles and a reading list for learning about Palestinian history, culture, and the ongoing struggle for self-determination.
    Link: https://decolonizepalestine.com/
  • History of Palestine (Wikipedia)
    A detailed overview of Palestine’s history, from ancient times through various empires to the modern era, including cultural and political developments.
    Link: https://en.wikipedia.org/wiki/History_of_Palestine

These links provide a mix of historical, cultural, and diplomatic perspectives on Palestine, with some connections to Bengali contexts through Bangladesh’s solidarity with Palestine.

read more

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *