রাজনীতি

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে মতিউর রহমান নিজামীর বিতর্কিত ভূমিকা

মতিউর রহমান নিজামী ছিলেন একজন বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রাক্তন আমীর। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৬ সালের ১১ই মে তাকে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে গণহত্যা, ধর্ষণ এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে। নিজামী ১৯৭১ সালে কুখ্যাত আল-বদর মিলিশিয়া বাহিনীর নেতৃত্ব দেন, যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে প্রায় ৯৮৯ জন বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ ও হত্যা করে।

মৃত্যুদণ্ডের আগে তিনি সংসদ সদস্য এবং কৃষিমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

বিস্তারিত:

মতিউর রহমান নিজামীর প্রারম্ভিক জীবন ও রাজনৈতিক উত্থান:

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে মতিউর রহমান নিজামীর বিতর্কিত ভূমিকা

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়কালে মতিউর রহমান নিজামীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত এবং পরবর্তীকালে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের অন্যতম প্রধান কারণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজামী ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি। জামায়াতে ইসলামী দলগতভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করে এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে অবস্থান নেয়। নিজামী এই দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ছিলেন না এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

আল-বদর বাহিনীর নেতৃত্ব:

মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত কুখ্যাত আল-বদর বাহিনীর নেতৃত্ব দেন মতিউর রহমান নিজামী। এই বাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত ছিল। আল-বদর বাহিনীর মূল কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করা, তাদের ধরিয়ে দেওয়া এবং বুদ্ধিজীবীসহ স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের হত্যা করা। বিভিন্ন সূত্র ও ঐতিহাসিক বিবরণ অনুযায়ী, নিজামী আল-বদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে এই সকল কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বুদ্ধিজীবী হত্যায় সংশ্লিষ্টতা:

একাত্তরের ১৪ই ডিসেম্বর সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছিল মুক্তিযুদ্ধের একটি কলঙ্কময় অধ্যায়। এই হত্যাকাণ্ডে দেশের বহু বরেণ্য শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক ও আইনজীবীকে আল-বদর বাহিনী অপহরণ করে নির্মমভাবে হত্যা করে। অভিযোগ রয়েছে, মতিউর রহমান নিজামী এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারীদের একজন ছিলেন। আল-বদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে তিনি বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি এবং তাদের অপহরণ ও হত্যার নির্দেশ দেন বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল ও সাক্ষ্যে উঠে এসেছে।

গণহত্যা ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ:

মুক্তিযুদ্ধের সময় আল-বদর বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো ভয়াবহ অপরাধে লিপ্ত ছিল। নিজামীর বিরুদ্ধে পাবনার ডেমরা, বাউসগাতি ও রূপসা গ্রামে প্রায় সাড়ে চারশো হিন্দুকে হত্যা এবং নারীদের ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগ ওঠে। এছাড়াও, সাঁথিয়া থানার করমজা গ্রামে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বহু লোককে হত্যা ও নারীদের ধর্ষণের ঘটনায় তার নির্দেশ ছিল বলে অভিযোগ করা হয়।

ঈশ্বরদী উপজেলার আড়পাড়া ও ভূতের বাড়ি গ্রামে ২১ জনকে হত্যা এবং ঘরবাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায়ও নিজামীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া যায়। এছাড়া, পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে ৫২ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যার ঘটনায় তার নির্দেশ ছিল বলে সাক্ষ্যপ্রমাণে উঠে আসে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় মতিউর রহমান নিজামীর এই ভূমিকা তাকে বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। স্বাধীনতার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ওঠে এবং দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন।

MOtiur Rahman Nijami-Dhaka post
Motiur Rahman Nijami

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে মতিউর রহমান নিজামীর সংশ্লিষ্টতায় ঘটা ২০টি গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়ংকর ঘটনা নিচে সোর্স লিঙ্ক সহ উল্লেখ করা হলো:

১. আল-বদর বাহিনী গঠন ও নেতৃত্ব: নিজামীর নেতৃত্বে ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত আল-বদর বাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটে লিপ্ত ছিল। সূত্র: বাংলাপিডিয়া – মতিউর রহমান নিজামী

২. বুদ্ধিজীবী হত্যা পরিকল্পনা: নিজামীর বিরুদ্ধে ১৪ই ডিসেম্বর সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে থাকার অভিযোগ রয়েছে। আল-বদর প্রধান হিসেবে তিনি বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি এবং তাদের অপহরণ ও হত্যার নির্দেশ দেন বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল ও সাক্ষ্যে উঠে এসেছে। সূত্র: প্রথম আলো – বুদ্ধিজীবী হত্যা: জল্লাদদের যারা বাঁচিয়েছিল

৩. ডেমরা গণহত্যা: নিজামীর নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার ও আল-বদর বাহিনী পাবনার ডেমরা, বাউসগাতি ও রূপসা গ্রাম ঘিরে প্রায় সাড়ে চারশো হিন্দুকে নির্বিচারে হত্যা করে এবং নারীদের ধর্ষণ করে। [সূত্র: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর রায়]

৪. করমজা গণহত্যা: নিজামীর নির্দেশে ১৯৭১ সালের ৮ই মে পাবনার সাঁথিয়া থানার করমজা গ্রামে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বহু লোককে হত্যা ও নারীদের ধর্ষণ করা হয়। সূত্র: সামকাল – নিজামীর যত অপরাধ

৫. ঈশ্বরদীতে গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ১৬ই এপ্রিল নিজামীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা ঈশ্বরদী উপজেলার আড়পাড়া ও ভূতের বাড়ি গ্রামে ২১ জনকে হত্যা করে এবং ঘরবাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগ করে। সূত্র: দৈনিক যুগান্তর – নিজামীর বিরুদ্ধে গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ

৬. ধুলাউড়ি গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ২৭শে নভেম্বর নিজামীর নির্দেশে পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা অভিযান চালিয়ে ৫২ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে। সূত্র: দৈনিক যুগান্তর – নিজামীর বিরুদ্ধে গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ

৭. নূরপুর পাওয়ার হাউসে হত্যা: ১৯৭১ সালের ৪ জুন নিজামীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা পাবনা জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিনকে অপহরণ করে নূরপুর পাওয়ার হাউসের ক্যাম্পে নিয়ে যায়, সেখানে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। সূত্র: প্রথম আলো – নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬ অভিযোগ

৮. মোহাম্মদপুরে নির্যাতন: ১৯৭১ সালের মে মাস থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিজামীর নিয়মিত যাতায়াত ছিল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজের ক্যাম্পে, যেখানে পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী বহু মানুষকে নির্যাতন করে হত্যা করে। সূত্র: প্রথম আলো – নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬ অভিযোগ

৯. করমজা গ্রামে হত্যা ও অগ্নিসংযোগ: ১৯৭১ সালের ৮ মে নিজামী, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা পাবনার করমজা গ্রামের নয়জনকে হত্যা করে এবং ঘরবাড়িতে আগুন দেয়। সূত্র: প্রথম আলো – নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬ অভিযোগ

১০. আড়পাড়া ও ভূতের বাড়ি গ্রামে হত্যা: ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল নিজামীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা ঈশ্বরদী উপজেলার আড়পাড়া ও ভূতের বাড়ি গ্রামে ২১ জনকে হত্যা করে এবং ঘরবাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগ করে। সূত্র: প্রথম আলো – নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬ অভিযোগ

১১. ধুলাউড়ি গ্রামে হত্যা: ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর নিজামীর নির্দেশে পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা অভিযান চালিয়ে ৫২ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে। সূত্র: প্রথম আলো – নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬ অভিযোগ

১২. বৃশালিখায় হত্যা: নিজামীর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানি সেনারা পাবনার বৃশালিখা গ্রাম চারদিক থেকে ঘিরে ৭০ জনকে হত্যা করে এবং ৭২টি বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। সূত্র: প্রথম আলো – নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬ অভিযোগ

১৩. সোহরাব আলীকে হত্যা: ৩ নভেম্বর নিজামীর দেওয়া তথ্য অনুসারে বৃশালিখা গ্রামের সোহরাব আলীকে পাকিস্তানি সেনারা আটক ও হত্যা করে। সূত্র: প্রথম আলো – নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬ অভিযোগ

১৪. রুমী, বদি, জালাল ও আলতাফ মাহমুদকে হত্যা: ৩০ আগস্ট নিজামী ঢাকার নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে গিয়ে আটক রুমী, বদি, জালাল, আলতাফ মাহমুদকে হত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচনা দেন। সূত্র: প্রথম আলো – নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬ অভিযোগ

১৫. সোনাতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া: নিজামীর নির্দেশে রাজাকাররা সোনাতলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র কুণ্ডুর বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। সূত্র: প্রথম আলো – নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬ অভিযোগ

১৬. উস্কানিমূলক বক্তব্য: নিজামীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সভায় উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে, যা আল-বদর সদস্যদের মানবতাবিরোধী অপরাধে উৎসাহিত করে। সূত্র: প্রথম আলো – নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬ অভিযোগ

১৭. সাঁথিয়া ক্যাম্পে ষড়যন্ত্র: নিজামী রাজাকার সামাদ মিয়ার সঙ্গে সাঁথিয়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের রাজাকার ক্যাম্পে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র করতেন বলে অভিযোগ করা হয়। সূত্র: প্রথম আলো – নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬ অভিযোগ

১৮. গণহত্যায় প্ররোচনা: নিজামী বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চালানোর জন্য পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচনা দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

১৯. ধর্ষণে সহায়তা: নিজামীর বিরুদ্ধে আল-বদর সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত ধর্ষণসহ বিভিন্ন যৌন সহিংসতার ঘটনায় সহায়তা করার অভিযোগও রয়েছে।

২০. অবৈধ আটক ও নির্যাতন: নিজামীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে অনেক মুক্তিকামী বাঙালিকে অবৈধভাবে আটক ও নির্যাতনের অভিযোগও পাওয়া যায়।

এই ঘটনাগুলো মতিউর রহমান নিজামীর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভূমিকার কিছু ভয়ংকর দিক তুলে ধরে। এসব অপরাধের কারণেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।

ঢাকাপোস্ট ডট নেট

read more

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *