মনিষীদের জীবনী

ইমরান খান: জীবন থেকে রাজনীতি(Imran Khan)

এই জীবনীতে থাকবে:

  • শৈশব, পরিবার ও শিক্ষা
  • ক্রিকেট জীবন ও বিশ্বকাপ জয়
  • সমাজসেবা (শৌকত খানুম হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়)
  • রাজনীতিতে আগমন ও PTI গঠন
  • রাজনৈতিক সংগ্রাম, সাফল্য ও ব্যর্থতা
  • প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভূমিকা
  • পতন, মামলা ও কারাবরণ
  • ব্যক্তিগত জীবন (বিয়ে, সন্তান)
  • আদর্শ, দর্শন ও আন্তর্জাতিক প্রভাব
  • সমালোচনা, জনপ্রিয়তা ও উত্তরাধিকার


✍️ লেখক: মোহাম্মদ বাইতুল্লাহ
🌐 প্রকাশিত: ঢাকাপোস্ট ডট নেট


🔶 ভূমিকা

ইমরান আহমেদ খান নিয়াজি — একসময় যিনি ছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক এবং পরে হয়ে উঠেন দেশের সবচেয়ে আলোচিত রাজনীতিবিদ ও প্রধানমন্ত্রী। একজন বিশ্বকাপ জয়ী ক্রিকেটার থেকে রাষ্ট্রনেতা হয়ে ওঠার এই বিস্ময়কর যাত্রা শুধু পাকিস্তানের নয়, গোটা উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়, প্রতিটি বাঁক অসাধারণ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, যা আমাদের এই জীবনীতে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হবে।


🔷 ১. শৈশব ও পরিবার

ইমরান খান ১৯৫২ সালের ৫ অক্টোবর, পাকিস্তানের লাহোর শহরে এক সম্ভ্রান্ত পশতুন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবারের শিকড় আফগানিস্তানের মিয়ানওয়ালি অঞ্চলের পশতুন “নিয়াজি” উপজাতিতে। বাবা ইখতিয়ার খান ছিলেন একজন প্রকৌশলী এবং মা শৌকত খান ছিলেন একজন ঘরোয়া নারী।

তাঁর পরিবার শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা ছিল। ইমরান খান ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা, বিশেষত ক্রিকেটে গভীর আগ্রহ দেখিয়েছেন। তাঁর চাচাতো ভাই মজিদ খান পাকিস্তানের জাতীয় দলের একজন খ্যাতনামা ক্রিকেটার ছিলেন, যিনি পরবর্তীতে ইমরান খানের ক্যারিয়ারে বড় অনুপ্রেরণা হন।


🔷 ২. শিক্ষা জীবন

ইমরান খানের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় লাহোরের “Cathedral School”-এ এবং পরবর্তীতে তিনি ভর্তি হন “Aitchison College”-এ, যা পাকিস্তানের অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। এরপর তিনি যুক্তরাজ্যের “Royal Grammar School, Worcester” এ যান এবং শেষ পর্যন্ত ভর্তি হন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির “Keble College”-এ।

অক্সফোর্ডে তিনি দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতি (PPE) বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এখান থেকেই তাঁর চিন্তাধারা ও নেতৃত্বের বীজ রোপিত হয়।


🔷 ৩. ক্রিকেট ক্যারিয়ার

ইমরান খানের ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৭১ সালে। পাকিস্তান জাতীয় দলে প্রথম খেলেন ১৮ বছর বয়সে। তখন থেকেই তাঁর প্রতিভার ঝলক দেখা যায়।

✅ বিশ্বকাপ ১৯৯২: চূড়ান্ত গৌরব

১৯৯২ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ ছিল ইমরান খানের জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় মুহূর্ত। অধিনায়ক হিসেবে পাকিস্তানকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয় করান।
তিনি দলকে “Cornered Tigers” হিসেবে উল্লেখ করেন—একটি দুর্বল অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতীক হিসেবে। বিশ্বকাপ ফাইনালে তাঁর নেতৃত্ব, ব্যাটিং ও অনুপ্রেরণা আজও পাকিস্তানিদের কাছে কিংবদন্তিসম।

✅ ক্রিকেট পরিসংখ্যান:

  • টেস্ট ম্যাচ: ৮৮
  • উইকেট: ৩৬২
  • ব্যাটিং গড়: ৩৭.৬৯
  • ওয়ানডে ম্যাচ: ১৭৫
  • অধিনায়ক হিসেবে জিতেছেন: ৯১টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ

🔷 ৪. সমাজসেবা ও হাসপাতাল গঠন

ক্রিকেট থেকে অবসরের পর ইমরান খান নিজের মায়ের নামে “শৌকত খানুম মেমোরিয়াল ক্যান্সার হাসপাতাল” প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। পাকিস্তানে এ ধরনের ক্যান্সার চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ছিল না।

🎗️ শৌকত খানুম হাসপাতাল

১৯৯৪ সালে হাসপাতালটি উদ্বোধন হয়। এটি দান ও সহানুভূতির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। তাঁর প্রচারণায় সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ধনী শ্রেণি পর্যন্ত অর্থ দান করে।

🎓 ন্যামাল বিশ্ববিদ্যালয়

২০০৮ সালে ইমরান খান মিয়ানওয়ালিতে ন্যামাল কলেজ (পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া।

ইমরান-খান
ইমরান-খান

🔷 ৫. রাজনীতিতে আগমন

ইমরান খানের রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটে ১৯৯৬ সালে, যখন তিনি “পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (PTI)” নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ছিল দুর্নীতিমুক্ত, ইসলামিক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।

🚩 রাজনীতির শুরুর ধাক্কা

প্রথমদিকে ইমরানের রাজনৈতিক পথচলা ছিল কণ্টকাকীর্ণ। ২০০২ সালে তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়ে এমএনএ হন, কিন্তু তাঁর দল খুব একটা সাফল্য পায়নি।

২০০৮ সালের নির্বাচন বর্জনের পর তিনি আবার ঘুরে দাঁড়ান।


🔷 ৬. গণআন্দোলন ও উত্থান

২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর লাহোরে মিনার-ই-পাকিস্তানে বিশাল জনসমাবেশ করেন, যা তাঁর রাজনীতির নতুন মোড় নেয়। এরপর থেকেই তিনি জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন।

🔥 ২০১৪ – “ধর্ণা আন্দোলন”

ইমরান খান নির্বাচন জালিয়াতির অভিযোগ এনে ১২৬ দিন ইসলামাবাদে “ধর্ণা” (বিক্ষোভ) পালন করেন। এতে তিনি গণমানুষের চোখে একজন বিপ্লবী নেতা হয়ে উঠেন।


🔷 ৭. প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব

২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে ইমরান খানের দল PTI সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এরপর তিনি ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

🛠️ প্রধানমন্ত্রিত্বের অর্জন:

  • “Ehsaas Program” – দারিদ্র্য হ্রাসের জন্য বৃহত্তম সমাজসেবা প্রকল্প
  • স্বাস্থ্য কার্ড ও রেশন কার্ড
  • পাকিস্তান রেলওয়ের উন্নয়ন
  • জলবায়ু পরিবর্তনে বন রোপণ কার্যক্রম (“Billion Tree Tsunami”)

🔷 ৮. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বৈদেশিক নীতি

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি আরব, তুরস্ক, ইরান—প্রতিটি দেশের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন।

🇺🇸 যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক

ইমরান খান যুক্তরাষ্ট্রের “War on Terror”-এ পাকিস্তানের ভূমিকাকে প্রায়ই সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন পাকিস্তান ভাড়াটে রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। তিনি ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করেন এবং আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

🇨🇳 চীনের সঙ্গে সম্পর্ক

চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) তাঁর সরকারে নতুন গতি পায়। তিনি বলেন, চীনের মডেল পাকিস্তানের জন্য আদর্শ হতে পারে, বিশেষ করে দারিদ্র্য হ্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে।

🇸🇦 সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্য

ইমরান খান সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেন, তবে একইসঙ্গে ইরানের সঙ্গেও সংলাপ চালিয়ে যান—যা দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির ভারসাম্যের ইঙ্গিত দেয়। কাশ্মীর ইস্যুতে তিনি মুসলিম বিশ্বের সংহতির ডাক দেন।


🔷 ৯. ক্ষমতাচ্যুতি ও বিতর্ক

২০২২ সালের এপ্রিলে ইমরান খানের সরকার অনাস্থা ভোটে পরাজিত হয়ে পড়ে। বিরোধী দলগুলো দাবি করে, তাঁর সরকার ব্যর্থ ও একনায়কতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। তবে ইমরান খান ও তাঁর সমর্থকরা এটিকে “বিদেশি ষড়যন্ত্র” বলে অভিহিত করেন।

🚨 রাজনৈতিক টানাপড়েন

  • অর্থনৈতিক সংকট
  • রুপির পতন ও মুদ্রাস্ফীতি
  • সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব
  • মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সমালোচনা

তাঁর পতনের পর সারা দেশে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং PTI-এর জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়।

ইমরান-খান
ইমরান-খান

🔷 ১০. গ্রেফতার, মামলা ও কারাবরণ

২০২৩ সালে ইমরান খানের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের হয়—তথ্য গোপন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপব্যবহার, সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ। তিনি বারবার আদালতে হাজিরা দেন এবং অবশেষে কিছু মামলায় জামিন পেলেও, কিছুতে গ্রেফতার হন।

🔒 পাঞ্জাব পুলিশ অভিযান ও গ্রেফতার

  • পুলিশের অভিযান: জামান পার্কে সংঘর্ষ
  • গ্রেফতার: ইসলামাবাদ হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে
  • রায়: তোশাখানা কাণ্ডে ৩ বছর সাজা

তাঁর গ্রেফতারের পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, বহু PTI নেতাকর্মী গ্রেফতার হন, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়।


🔷 ১১. ব্যক্তিগত জীবন

ইমরান খানের ব্যক্তিগত জীবন সবসময় গণমাধ্যমে আলোচনার বিষয় হয়ে থেকেছে। তিনটি বিয়ে করেন তিনি, প্রতিটিই ছিল আলোচিত ও বিতর্কিত।

💍 প্রথম বিয়ে: জেমিমা গোল্ডস্মিথ (১৯৯৫–২০০৪)

ব্রিটিশ লেখক ও ফিলান্থ্রপিস্ট জেমিমার সঙ্গে বিয়ে করে দুই সন্তানের জনক হন — সুলেমান ও কাসিম। তবে সাংস্কৃতিক পার্থক্য ও রাজনৈতিক চাপের কারণে বিচ্ছেদ হয়।

💍 দ্বিতীয় বিয়ে: রেহাম খান (২০১৫)

পাকিস্তানি ব্রিটিশ সাংবাদিক রেহাম খানের সঙ্গে বিয়ে মাত্র ১০ মাস স্থায়ী হয়। বিচ্ছেদের পর রেহাম একটি বিতর্কিত আত্মজীবনী প্রকাশ করেন।

💍 তৃতীয় বিয়ে: বুশরা মানেকা (২০১৮)

বুশরা মানেকা ছিলেন এক আধ্যাত্মিক নারী, যাঁকে ইমরান খান তাঁর “ধর্মীয় পরামর্শদাতা” বলেও উল্লেখ করেন। এই বিয়েটিও নানা গুঞ্জন ও সমালোচনার জন্ম দেয়।


🔷 ১২. আদর্শ ও দর্শন

ইমরান খান সবসময় ইসলামিক কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণা প্রচার করেছেন। তিনি “মদিনা রাষ্ট্রের” আদর্শ অনুসরণে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন।

✨ মূল দর্শন:

  • দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন
  • গরিববান্ধব রাষ্ট্রনীতি
  • শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ
  • আত্মনির্ভরশীলতা
  • যুব সমাজের উন্নয়ন

🔷 ১৩. জনপ্রিয়তা ও প্রভাব

ইমরান খান পাকিস্তানের যুব সমাজের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর বক্তব্য, শরীরী ভাষা, সাহসিকতা এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেও অবস্থান নেওয়ার ক্ষমতা তাঁকে একজন ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।

📱 সোশ্যাল মিডিয়ায় উপস্থিতি

  • মিলিয়ন ফলোয়ার্স
  • লাইভ ভাষণ, ভিডিও বার্তা
  • TikTok, YouTube, Twitter ব্যবহারে অগ্রগামী রাজনীতিবিদ

🔷 ১৪. সমালোচনা ও বিতর্ক

যদিও ইমরান খান একজন শক্তিশালী নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তবুও তাঁকে ঘিরে আছে প্রচুর সমালোচনা।

❌ প্রধান অভিযোগ:

  • অর্থনীতিতে দুর্বল পারফরম্যান্স
  • গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস
  • উগ্র ধর্মীয় শক্তির প্রতি নমনীয়তা
  • রাজনীতিতে বিভাজন তৈরি

🔷 ১৫. উত্তরাধিকার ও ভবিষ্যৎ

ইমরান খানের রাজনীতি পাকিস্তানকে নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে—যেখানে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ বাড়ছে। তিনি রাজনৈতিকভাবে এখনও চ্যালেঞ্জিং এক শক্তি। তাঁর জনপ্রিয়তা যেমন তুঙ্গে, তেমনি বিতর্কও অসংখ্য।

🔮 ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

  • রাজনীতিতে পুনরায় ফিরে আসার সম্ভাবনা
  • তরুণ প্রজন্মের প্রতীক হয়ে উঠা
  • নতুন নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা

🔶 উপসংহার

ইমরান খানের জীবন এক বিরল যাত্রার নাম—ক্রিকেট মাঠ থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ক্যান্সার হাসপাতাল থেকে গণআন্দোলন, বিয়ের রোমাঞ্চ থেকে রাজনীতির উত্তাপ—সবকিছুই যেন এক জীবন্ত উপন্যাস। তিনি যেমন প্রশংসিত, তেমনই সমালোচিত। তবে ইতিহাসে তাঁর নাম থাকবে একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, বিতর্কিত, কিন্তু প্রভাবশালী নেতার তালিকায়।



নিচে ইমরান খানের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ২০টি ঘটনার তালিকা উপশিরোনামসহ, বড় ও বিস্তারিত অনুচ্ছেদে বাংলায় উপস্থাপন করা হলো। এই বিষয়গুলো তাঁর জীবনের মোড় ঘোরানো, রাজনৈতিক উত্থান, ব্যক্তিগত সংগ্রাম ও জাতীয় প্রভাবের দলিল হিসেবে বিবেচিত।


১. জন্ম ও পশতুন বংশের ঐতিহ্য

১৯৫২ সালের ৫ অক্টোবর পাকিস্তানের লাহোর শহরে জন্মগ্রহণ করেন ইমরান খান। তাঁর পরিবার ছিল পশতুন ‘নিয়াজি’ গোত্রভুক্ত। তাঁরা ছিলেন শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত এবং ব্রিটিশ ভারতের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সমাজের অংশ। এই পারিবারিক পটভূমি তাঁকে ভবিষ্যতের জন্য নেতৃত্বের বীজ বপন করেছিল।


২. ব্রিটিশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা অর্জন

ইমরান খানের শিক্ষা জীবনের একটা বড় অংশ কাটে ইংল্যান্ডে। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবল কলেজ থেকে PPE (Philosophy, Politics and Economics) বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর চিন্তাধারা, আচরণ এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির গঠন এই সময়েই গড়ে ওঠে।


৩. ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক

মাত্র ১৮ বছর বয়সে পাকিস্তান জাতীয় দলে জায়গা পান ইমরান খান। তাঁর ডানহাতি পেস বোলিং ও আগ্রাসী মনোভাব তৎকালীন সময়ের ক্রিকেটবিশ্বে তাঁকে দ্রুত পরিচিত করে তোলে। সেই সময় পাকিস্তান দলে আন্তর্জাতিক মানের পেসার খুব কম ছিল, তাই তাঁর আগমন ছিল গেম-চেঞ্জার।


৪. ১৯৮২ সালে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মনোনীত

ইমরান খান ১৯৮২ সালে জাতীয় দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হন। কঠোর পরিশ্রম, কৌশলী নেতৃত্ব ও খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করার ক্ষমতা তাঁকে অসাধারণ ক্যাপ্টেনে পরিণত করে। তাঁর অধীনে পাকিস্তান ক্রিকেট দলে একটি শৃঙ্খলা এবং পেশাদারিত্বের ধারা চালু হয়।


৫. ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ জয়

ইমরান খানের জীবনের সবচেয়ে গর্বিত মুহূর্ত ছিল ১৯৯২ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়। অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত এই টুর্নামেন্টে পাকিস্তান প্রথমদিকে ব্যর্থ হলেও, তাঁর অধিনায়কত্বে দল ঘুরে দাঁড়ায় এবং ফাইনালে ইংল্যান্ডকে পরাজিত করে। এই জয় তাঁকে জাতীয় বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।


৬. শৌকত খানুম ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা

মায়ের মৃত্যুর পর ১৯৯৪ সালে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রথম ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন – শৌকত খানুম মেমোরিয়াল ক্যান্সার হাসপাতাল। এটি ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম বড় দানবীর প্রকল্প। তিনি বলেন, “বিশ্বকাপ জেতার চেয়েও কঠিন ছিল এই হাসপাতাল তৈরি করা।”


৭. ১৯৯৬ সালে রাজনীতিতে প্রবেশ

ইমরান খান রাজনীতিতে আসেন “পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (PTI)” নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে। তাঁর লক্ষ্য ছিল দুর্নীতিমুক্ত ও কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। যদিও প্রথমদিকে এটি হাস্যরসের বিষয় ছিল, পরবর্তীতে এই দল পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হয়।


৮. ২০০২ সালের নির্বাচনে এমএনএ নির্বাচিত

দীর্ঘ সংগ্রামের পর ২০০২ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। এই সময় তিনি পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামো ও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।


৯. ২০১১ সালের লাহোর জনসভা

২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর লাহোরের মিনার-ই-পাকিস্তানে ইমরান খান এক বিশাল জনসভা করেন। এটি ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘোরানো ঘটনা। তিনি লাখো মানুষের সামনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও যুবসমাজকে পরিবর্তনের আহ্বান জানান।


১০. ২০১৩ সালের নির্বাচনে শক্ত অবস্থান

২০১৩ সালে ইমরান খানের PTI প্রথমবারের মতো জাতীয় রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে সরকার গঠন করে, যা দলের জন্য ছিল বিশাল সাফল্য।


১১. ২০১৪ সালের ইসলামাবাদ ধর্ণা

২০১৪ সালে ইমরান খান নির্বাচন জালিয়াতির অভিযোগ এনে ১২৬ দিনব্যাপী ‘ধর্ণা’ আন্দোলন করেন। এটি পাকিস্তানে গণআন্দোলনের নতুন ধারা চালু করে এবং ইমরান খানকে ‘জনগণের নেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।


১২. ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজয় ও প্রধানমন্ত্রীত্ব

২০১৮ সালের নির্বাচনে PTI বড় জয় পায় এবং ইমরান খান পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি ক্ষমতায় এসে “মদিনা রাষ্ট্র” গড়ার প্রতিশ্রুতি দেন, যা ছিল ইসলামিক কল্যাণরাষ্ট্রের রূপক।


১৩. “Ehsaas Program” চালু

ইমরান খানের সরকার ‘Ehsaas Program’ নামে দরিদ্রদের জন্য বৃহত্তম সমাজসেবা প্রকল্প চালু করে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে খাদ্য, নগদ অর্থ এবং চাকরি সহায়তা দেওয়া হয়।


১৪. করোনা মহামারিতে নেতৃত্ব

২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির সময় ইমরান খান ‘স্মার্ট লকডাউন’ নীতির মাধ্যমে অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্য দুটিকেই সামলানোর চেষ্টা করেন। WHO-সহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা তাঁর কৌশলের প্রশংসা করে।


১৫. বৈদেশিক সম্পর্ক ও কূটনীতি

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান চীন, সৌদি আরব, ইরান ও তুরস্কের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন। কাশ্মীর ইস্যুতে তিনি বিশ্বমঞ্চে পাকিস্তানের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন।


১৬. তোশাখানা কেলেঙ্কারি

২০২২ সালে তোশাখানা মামলায় ইমরান খানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় উপহার গোপন করার অভিযোগ ওঠে। এই মামলায় তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।


১৭. অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানো

২০২২ সালের এপ্রিল মাসে একটি অনাস্থা প্রস্তাবে তিনি পরাজিত হন এবং প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি এ ঘটনার পেছনে “বিদেশি ষড়যন্ত্র” ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকে দায়ী করেন।


১৮. ২০২৩ সালের গ্রেফতার ও বিক্ষোভ

২০২৩ সালে তাঁকে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে গ্রেফতার করা হয়। দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, PTI নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয় এবং ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়।


১৯. তিনটি বিবাহ ও ব্যক্তিগত জীবন

ইমরান খান তিনবার বিবাহ করেন – জেমিমা (১৯৯৫–২০০৪), রেহাম খান (২০১৫), এবং বুশরা মানেকা (২০১৮)। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সবসময় মিডিয়া ও জনসাধারণের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে।


২০. পাকিস্তানের ইতিহাসে ব্যতিক্রমী নেতা

ইমরান খান পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি একাধারে ক্রীড়াবিদ, সমাজসেবী, দার্শনিক ও রাষ্ট্রনায়ক। তাঁর নাম পাকিস্তানের ইতিহাসে চিরকাল লেখা থাকবে — এক সংগ্রামী, বিতর্কিত কিন্তু অদম্য নেতার প্রতীক হিসেবে।


🔗 ইমরান খানের জীবনী সম্পর্কিত বিশ্বস্ত সূত্র:

  1. Wikipedia – Imran Khan
    (সর্বাধিক বিস্তারিত তথ্য, তাঁর ক্রিকেট ও রাজনৈতিক জীবনসহ)
  2. Britannica Biography – Imran Khan
    (ইতিহাসভিত্তিক ও গবেষণাভিত্তিক প্রোফাইল)
  3. The Guardian – Imran Khan News
    (আধুনিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদন)
  4. Al Jazeera – Imran Khan Profile
    (রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও দক্ষিণ এশিয়া ফোকাস)
  5. Dawn News – Imran Khan Archive
    (পাকিস্তানের জাতীয় সংবাদমাধ্যমে তথ্যভিত্তিক নিউজ আর্কাইভ)
  6. BBC News – Imran Khan
    (আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর রাজনৈতিক পথচলা)
  7. NDTV – Imran Khan Biography
    (বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মোড়)


📌 এই নিবন্ধটি লিখেছেন: মোহাম্মদ বাইতুল্লাহ
📍 উৎস প্রকাশনা: ঢাকাপোস্ট ডট নেট

ঢাকাপোস্ট ডট নেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *